বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার জ্যেষ্ঠজন নূরে আলম সিদ্দিকী

নূরে আলম সিদ্দিকী

: সৈয়দ ফারুক হোসেন : 

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সত্তরের দশকের ছাত্রনেতা এবং বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার একজন বলে খ্যাত নূরে আলম সিদ্দিকী রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ মার্চ ভোররাতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

হাসপাতাল থেকে নূরে আলম সিদ্দিকীর মরদেহ সকাল ১০টায় ঝিনাইদহে নেওয়া হয়। সেখানে জানাজার পর বাদ আসর ঢাকার গুলশানের আজাদ মসজিদে তার জানাজা হয়। এ সময় নূরে আলম সিদ্দিকীকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। এর পর সাভারে নিজের করা মসজিদের পাশে তাকে কবরস্থ করা হয়।

তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য স্বজন, ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। ঢাকার সাভারে নিজের তৈরি মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সাবেক ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক নূরে আলম সিদ্দিকী।

নূরে আলম সিদ্দিকীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ দেশ-বিদেশের সর্বস্তরের মানুষ।

নূরে আলম সিদ্দিকী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন এবং সত্তরের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ যে চার ছাত্রনেতাকে সে সময় ‘চার খলিফা’ হিসেবে অভিহিত করা হতো তাঁদের অন্যতম ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ এবং ২৩ মার্চসহ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রলীগের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার অন্যতম অংশীদার নূরে আলম। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন সংগ্রামী ও গণতন্ত্রের আপসহীন পূজারিকে হারাল।

নূরে আলম সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৪০ সালের ২৬ মে ঝিনাইদহে। বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে সেই উত্তাল সময় ১৯৭০-৭২ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তিনি মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-২ আসন (বর্তমানে ঝিনাইদহ-২) থেকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর এক ছেলে তাহজীব আলম সিদ্দিকী ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য।

নূরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দেশপ্রেমিক রাজনীতির বটবৃক্ষ। দেশ ও মানুষের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিলো অপরিসীম। রাজনীতিতে তিনি যে সাহস দেখিয়েছেন তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে নূরে আলম সিদ্দিকীর বীরোচিত অবদান অক্ষয় হয়ে থাকবে। এককালের তুখোড় এই ছাত্রনেতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। নূরে আলম সিদ্দিকীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ এক অকৃত্রিম অভিভাবক হারালো। তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো তা সহসাই পূরণ হবার নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন অনন্য সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতির এই সাহসী সন্তানের অবদান পরবর্তী প্রজন্ম চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

নূরে আলম সিদ্দিকীকে শোক ও শ্রদ্ধায় ঝিনাইদহের সর্বস্তরের মানুষ বিদায় জানিয়েছেন। ঝিনাইদহ-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে যান। তাকে এক নজর দেখতে সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হন। চোখের জলে প্রিয় মানুষকে বিদায় জানিয়েছেন অনেকেই।

নূরে আলম সিদ্দিকী যিনি বাঙালি জাতির একটি চলমান ইতিহাসের নাম। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে আন্দোলনের অনন্য এক স্ফুলিঙ্গ। অনলবর্ষী বক্তা। চার খলিফার এক খলিফা হিসেবে পরিচিত ছিলেন যিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামসহ দেশের ইতিহাস খ্যাত সব আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এক মহীয়সী নেতা। তাঁর মৃত্যুতে জাতি একজন তুখোড় রাজনীতিবিদকে হারাল। এই ক্ষতি অপূরণীয়।

মুজিব বাহিনীর অন্যতম কর্ণধার ও প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক নূরে আলম সিদ্দিকী ছয় দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। নূরে আলম সিদ্দিকী ছয় দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বহুবার কারাবরণ করা এ নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে কাজ করে গেছেন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে চারজন ছাত্র নেতার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। যে কারণে চার খলিফার একজন হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর।

গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা নিয়ে লিখেছেন বই। কথা বলেছেন গণমাধ্যমে। বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। শিল্পপতি হিসেবে দেশের বাইরেও নাম ছড়িয়েছিল তাঁর। স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে নূরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন অন্যতম ঐতিহাসিক চরিত্র। সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে পান্ডিত্যপূর্ণ ভাষায় উপস্থাপন করায় তিনি ছিলেন অসাধারণ একজন বাগ্মী। ভাষা আন্দোলন ও ছয় দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছাড়াও তৎকালীন সব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন নূরে আলম সিদ্দিকী। তিনি ৬০ দশকের বিপুল গণজাগরণের অন্যতম ভাষ্যকার। তাঁর এই মৃত্যুতে দেশ একজন সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা, চিন্তাবিদ ও পথপ্রদর্শক হারালো। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতির এই সাহসী সন্তানের অবদান পরবর্তী প্রজন্ম চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

লেখক : রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়