মেজর সিনহা হত্যা মামলার রায়ে ওসি প্রদীপসহ ২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৬ জনের যাবজ্জীবন

বাংলারচিঠিডটকম ডেস্ক ❑ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায়ে আসামি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া এই মামলায় আরও ৬ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আদালত ৭ আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ। আদালত মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডও দিয়েছেন।

মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন এপিবিএনের এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল মো. রাজীব, মো. আব্দুল্লাহ, পুলিশের কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, লিটন মিয়া ও পুলিশের কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন।

কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল ৩১ জানুয়ারি বিকেলে এই রায় ঘোষণা করেন। এই সময়ে আদালতে উপস্থিত ছিলেন নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস।

আদালতে রায় ঘোষণা করার পর আসামির কাঠগড়ায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে নির্বিকার দেখা যায়। এই সময়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি করেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি টেকনাফের মারিশবুনিয়া গ্রামের মোহাম্মদ আয়াছ ও নিজাম উদ্দিন।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল দুপুর ২টা ১৭ মিনিটের দিকে মামলার ৩শ’ পৃষ্ঠার রায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠ শুরু করেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তিনি আসামিদের দণ্ড ঘোষণা করে এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন। আদালত এই সময়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘আমি মেজর সিনহা হত্যা মামলাটির বিভিন্ন ইস্যু খুঁটিনাটি খোঁজার চেষ্টা করেছি। এতে প্রমাণিত হয় সিনহা হত্যা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’

রায় ঘোষণা করার পর মামলার বাদি সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন- ‘এই রায় আমাদের প্রত্যাশিত হলেও, রায় কার্যকর হলেই সন্তুষ্ট হবো।’

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ফরিদুল আলম বলেন- সিনহা হত্যা মামলায় ১৫ আসামির সবার সাজা হবে প্রত্যাশা করেছিলাম। আমরা প্রমাণ করেছি এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু সব আসামির সাজা না হওয়ায় আমরা হতাশ।

সিনহা হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে সকাল থেকেই কক্সবাজার আদালত প্রাঙ্গনে ছিল কড়া নিরাপত্তা। সকালে আদালতে পৌঁছানোর পর আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সকলকে প্রধান ফটক থেকে শুরু করে এজলাস পর্যন্ত যেতে কয়েক দফা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিবন্ধকতা পার হতে হয়।

কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। ওই কাজে তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।

পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। বিষয়টি উল্লেখ করে এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় সিনহার সঙ্গী সিফাতকে।

কিন্তু সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের ৬ দিন পর ৫ আগস্ট কক্সবাজারের আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র্যা বকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। তদন্ত শেষে র্যা ব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর চার্জশিট প্রদান করেন। এরপর ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেন। তারপর ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন।

সবশেষে গত ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি মামলায় দু’পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করলে বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়। আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। মামলার ১৫ আসামি মধ্যে ১২ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। এদের মধ্যে পুলিশের ৯ জন ও এপিবিএনের ৩ জন। অপর ৩ জন পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী ও স্থানীয় বাসিন্দা।

এই মামলার আসামিরা হলেন- বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, লিটন মিয়া, এপিবিএন এর তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাবেক এএসআই সাগর দেব।

আসামিদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১৩ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গতবছর ২৭ জুন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. ইসমাইল মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

সিনহা হত্যা মামলায় বাদী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন- কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর পিপি আইনজীবী ফরিদুল আলম, অতিরিক্ত পিপি আইনজীবী মোজাফফর আহমদ হেলালী, এপিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী জিয়া উদ্দিন আহমদ, আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা, আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, আইনজীবী সৈয়দুল ইসলাম, আইনজীবী এসমিকা সুলতানা, আইনজীবী শাহ আলম, আইনজীবী আবুল আলা জাহাঙ্গীর প্রমুখ।

অন্যদিকে আসামিদের পক্ষে রয়েছেন আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত, আইনজীবী দিলীপ দাশ, আইনজীবী শামশুল আলম, আইনজীবী মমতাজ আহমদ, আইনজীবী মোহাম্মদ জাকারিয়া, আইনজীবী চন্দন দাশ, আইনজীবী এম.এ বারী, আইনজীবী নুরুল হুদা, আইনজীবী ওসমান সরওয়ার আলম শাহীন, আইনজীবী মোশাররফ হোসেন শিমুল, আইনজীবী ইফতেখার মাহমুদ প্রমুখ আইনজীবী।সূত্র:বাসস।