সম্মানজনক পেশায় কর্মসংস্থানের সুযোগ চান শেরপুরের হিজড়ারা

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজি কিংবা বাজারে তোলা তুলে আর জীবনযাপন করতে চাননা শেরপুরের হিজড়ারা। জীবন ধারণের জন্য সম্মানজনক পেশায় কর্মসংস্থানের সুযোগ চান তৃতীয় লিঙ্গের এই জনগোষ্ঠি। সরকারি-বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানে পিয়নের চাকরি, টেইলারিং, গাড়িচালনা, দোকান পরিচালনা, বিউটি পার্লার, বাজারের ঝাড়ুদার-এমন যেকোনো কর্মে নিয়োজিত হতে চান তারা। ২৩ সেপ্টেম্বর বিকালে তৃতীয় লিঙ্গ (হিজড়া) জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান ভাবনা বিষয়ক এক সভায় হিজড়ারা আত্মকর্মের প্রশিক্ষণ ও উপযুক্ত কর্মসংস্থানের দাবি তুলে ধরেন। শেরপুর সরকারি কলেজ মিলনায়তনে নাগরিক প্ল্যাটফরম জনউদ্যোগ শেরপুর কমিটি, জেলা হিজড়া কল্যাণ সংস্থা ও বেসরকারি উন্নয়ণ সংস্থা আইইডি যৌথভাবে এ ভাবনা বিনিময় সভাটির আয়োজন করে।

হিজড়া কল্যাণ সংস্থার সভাপতি নিশি আক্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভাটি সঞ্চালনা করেন জনউদ্যোগ আহ্বায়ক শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ।

এতে শেরপুর সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রশীদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আমিনুল ইসলাম, সদর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন, ব্র্যাক জেলা প্রতিনিধি ফারহানা মিল্কী, নারী উদ্যোক্তা আইরীন পারভীন, শ্রেষ্ঠ ইমাম পুরষ্কারপ্রাপ্ত হাফেজ শাহীন, জেলা উদীচী সভাপতি তপন সারোয়ার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

এছাড়া অধ্যাপক শিব শংকর কারুয়া, আওয়ামী লীগ নেতা শামীম হোসেন, বিতার্কিক ইমতিয়াজ চৌধুরী, নারী নেত্রী আঞ্জুমান আরা যুথী, তিথী নন্দী, সাংবাদিক হাকিম বাবুল, ধর্মীয় নেতা কমল চক্রবর্তী উদ্দীপনামুলক বক্তব্য রাখেন।

সভার শুরুতে জনউদ্যোগ আহ্বায়ক শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ শেরপুরের হিজড়াদের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, শেরপুরে প্রায় অর্ধশতাধিক হিজড়াকে ভাড়া বাসায় থেকে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে তাদের কর্মসংস্থানের কোন সুযোগ নেই। যে কারণে ভিক্ষাবৃত্তি, উৎসব-অনুষ্ঠানাদিতে হানা দিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করে কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করেই চলতে হচ্ছে তাদের। তাদেরও সমাজের অন্য পাঁচজনের মতো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। স্বাভাবিক চলাফেরার অধিকার আছে। কেউ তাদের ভালো চোখে দেখে না। ফলে প্রতিনিয়তই লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হচ্ছে। তাদের মৌলিক অধিকার ভোগের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে তারাও সমাজের মূলস্রোতধারায় ফিরে আসতে পারে। সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা প্রয়োজন। আশার কথা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হিজড়াদের আবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এসময় হিজড়াদের মধ্য থেকে কেউ কেউ টেইলারিং, কেউ গবাদি পশুপালন, কেউ দোকান করে ব্যবসা পরিচালনা এবং কেউ কেউ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পিয়ন কিংবা ঝাড়ুদারের চাকরি করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কেউ ড্রাইভিং শেখার আগ্রহ দেখান এবং সম্মানজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলেন।

হিজড়া নিশি সরকার বলেন, আমরাও মানুষ। আমরাও অন্যান্যদের মতো ভালোভাবে জীবন যাপন করতে চাই। আমরাও ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া-পড়া ও পেশার নিশ্চয়তা চাই। আমরা আর অমানবিক জীবন চাইনা।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠির জন্য আমরা কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই। তাদেরকে নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করার পাশাপাশি তারা যাতে ভালো ভাবে জীবনযাপন করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে চাই। সরকারের যেসকল সুযোগ আছে আমরা তাদেরকে তার ভেতর অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। কিন্তু এজন্য তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠির আগ্রহ ও উদ্যোগ থাকতে হবে।

শেরপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রশীদ বলেন, কেউ নিজে ভালো হতে না চাইলে কেউ তাকে ভালো করে দিতে পারবে না। এজন্য হিজড়াদের নিজেদের কমিটেড হওয়ার আহ্বান জানান।

সদর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের কেউ কোন কাজের জন্য এগিয়ে এলে আমরা অবশ্যই তার কর্মসংস্থানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

ইমাম হাফে শাহীন বলেন, যদি হিজড়ারা আগ্রহী হয়, তাহলে তাদেরকে বিনামূল্যে ইমাম সমিতির পক্ষ থেকে আমরা ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করবো।

নারী উদ্যোক্তা আইরীন পারভীন তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হিজড়াদের জন্য সেলাই ও সুঁই-সুতার কাজের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেবেন বলে জানান।

সভায় জেলার তৃতীয় লিঙ্গের ৪০ জন হিজড়া ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, ধর্মীয় নেতা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সুধীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।