সরকারের যত্ন প্রকল্পে অযত্নের ছাপ

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায় সরকারের চলমান যত্ন প্রকল্পে আযত্নের ছাপ পড়েছে। এ প্রকল্পটি ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর দা পুওরেস্ট (আইএসপিপি) সংক্ষেপে যা যত্ন নামে পরিচিত। আর সরকারি বিধি অনুয়ায়ী প্রকল্পে নাম অর্ন্তভুক্ত করতে উপকার প্রত্যাশীদের যাচাই বাছাই করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে নাম তালিকাভুক্ত করতে হবে। অভিযোগ উঠেছে উপজেলায় প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর থেকে জনপ্রতিনিধিরা উপকার প্রত্যাশীদের নামের তালিকা প্রণয়নে কারচুপির আশ্রয় নিচ্ছেন। তালিকা থেকে বাদ পড়া উপকার প্রত্যাশীরা বলছেন কেন তারা তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এর উত্তর কেউ দিচ্ছেন না। অনেকে টাকা দিয়েও নাম তালিকায় ওঠাতে পারেননি। তবে যারা জনপ্রতিনিধিদের বেশি টাকা দিতে পেরেছেন তাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

যত্ন প্রকল্পের উপজেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গরিব অন্ত:সত্ত্বা নারী ও পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্থানীয় সরকার বিভাগ অতিদরিদ্রদের জন্য আইএসপিপি-যত্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আয় সহায়ক কর্মসূচী গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৭টি জেলার ৪৩টি উপজেলায় অতিদরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের সুনির্দিষ্ট সেবা গ্রহণের বিপরীতে নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। প্রায় ছয় লাখ দরিদ্র উপকারভোগী এ প্রকল্পের আওতায় সরাসরি উপকৃত হবেন। এ প্রকল্পের আওতায় শ্রীবরদী উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ১৩ হাজার ৪০০ পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বেশ কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে ওইসব পরিবারগুলো এ প্রকল্পে অর্ন্তভুক্ত হবে। সেগুলো হলো যাদের ৫০ শতাংশের কম জমি রয়েছে। এমন পরিবার যারা অন্ত:সত্ত্বা নারী এবং শূন্য থেকে ২৪ মাস বয়স ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। প্রকল্পটিতে তালিকাভুক্ত হতে পারলে যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে তা হচ্ছে অন্ত:সত্ত্বা নারী চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালে চার হাজার টাকা এবং টানা তিনবার করলে একটি বোনাস ভাতা পাবেন। শিশু জন্ম নেওয়ার পর ২৪ মাস পর্যন্ত মা ও শিশু এক হাজার ৪০০ টাকা করে পাবেন। শিশুর বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিন মাস পরপর ৭০০ টাকা করে পাবেন। প্রকল্প চলাকালে সুবিধাভোগীরা কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চতা, ওজনসহ নিয়মিত পরীক্ষা করতে এলেও অর্থ পাবেন।

সরেজমিনে গেলে কথা হয় রানীশিমুল ইউনিয়নের বিলভরট গ্রামের নূর মোহাম্মদের সাথে তিনি জানান, তার এক ছেলে দুই মেয়ে। একই গ্রামের বাসিন্দা সবুজ মিয়া। তার এক ছেলে দুই মেয়ে। পার্শ্ববর্তী তীতলীয় বিলভর গ্রামের মিজান। তার দুই মেয়ে এক ছেলে। এ পরিবারগুলোর সন্তানদের বয়স পাঁচ বছরের বেশী হলেও তাদের নাম যত্ন প্রকল্পে তালিকাভুক্ত হয়েছে। অথচ তাদের বাড়ির পাশে অনেকে রয়েছেন সেসব পরিবারের সন্তানদের বয়স চার বছরের নিচে হলেও তাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। উপকার প্রত্যাশী তাতিহাটি ইউনিয়নের বকচর গ্রামের সইজদ্দিনের স্ত্রী রেহেনা বেগম, রেজুয়ান মিয়ার স্ত্রী সঙ্গীতা বেগম ও লফাজ উদ্দিনের স্ত্রী শাহানা বেগমসহ আরো অনেকে। তাদের অভিযোগ, যত্ন প্রকল্পের সুবিধা পেতে তালিকাভুক্ত হতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের শরণাপন্ন হন তারা। পরে জনপ্রতিনিধিরা শিশুর ও মায়েদের জন্ম সনদ উত্তোলনের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি এর বেশি টাকা তাদের কাছ থেকে নেন। এরপর জানান শিশুর টিকা কার্ডসহ আরো কিছু কাগজপত্র লাগবে। পরে মায়েরা জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকটি, শিশুর জন্ম সনদের ফটোকপি ও টিকা কার্ডের ফটোকপি জমা দেন। সব কাগজপত্র জনপ্রতিনিধিদের কাছে নিয়ে গেলে যত্ন প্রকল্পে নাম তালিকাভুক্ত করতে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। অনেকে তালিকাভুক্ত হতে চাহিদা মাফিক টাকা দিয়েছেন। কেউবা টাকা দিয়েও নাম তালিকায় ওঠাতে পারেননি।

উপকার প্রত্যাশী রেহানা পারভিনের অভিযোগ, যারা জনপ্রতিনিধিদের বেশি টাকা দিতে পেরেছেন তাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। অনেকে নাম তালিকাভুক্ত করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে যান। তার সুপারিশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছে জমাও দেন। এতেও নাম তালিকাভুক্ত হয়নি। যে কারণে শতশত উপকার প্রত্যাশী নারী এ প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। শুধু তাই না স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অর্থের বিনিময়ে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে তাদের ইচ্ছা মাফিক নাম অন্তর্ভুক্ত করে যাচ্ছেন। এভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। যে কারণে সরকারের চলমান যত্ন প্রকল্পে আযত্নের ছাপ পড়েছে।

রানীশিমুল ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মাহবুব বলেন, যত্ন প্রকল্পের সুপারভাইজাররা কিছু খরচ নিয়েছে। এ কারণে উপকার প্রত্যাশী নারীদের কাছ থেকে কিছু টাকা নিতে হয়েছে।

টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে তাতিহাটি ইউপি চেয়ারম্যান আসাদউল্লাহ বিল্লাল বলেন, আমার এলাকায় সামান্য কয়েকটি নাম বাদ পড়েছে।

যত্ন প্রকল্পের উপজেলা সেফটিনেট প্রোগ্রাম এসিস্ট্যান্ট (এসপিএ) আনোয়ার হোসেন বলেন, উপকার প্রত্যাশীদের নাম তালিকাভুক্তির বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। আর এ নিয়ে যদি টাকা পয়সার লেনদেন হয়ে থাকে তাতে আমি কি করতে পারি। অন্যদিকে নিয়মবর্হিভূতভাবে তিন বা চার সন্তানের জননীরা এ প্রকল্পে তালিকাভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা ওইভাবে যাচাই বাছাই করতে পারি না। এ জন্য হয়তো অনেকের নাম তালিকায় এসেছে। এ বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই।

এ ব্যাপারে যত্ন প্রকল্পের সেফটিনেট প্রোগ্রাম সুপারভাইজার (এসপিএস) রিফাত জাহান লিজা বলেন, প্রকল্পের সহযোগী সংস্থা সুশীলন এখনো আমাদের কাছে উপকার প্রত্যাশীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দেয়নি। ওই তালিকা অনুযায়ী যাচাই বাছাই করা হবে। ওই সময় নিয়ম বর্হিভূতভাবে তালিকায় অর্ন্তভুক্তরা বাদ পড়তে পারে।

এ সম্পর্কে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা আক্তার।