জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে নষ্ট হচ্ছে ১৮ হাজার বই

জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরি। টেবিলে সংবাদপত্র। চেয়ার খালি। পর্দার ওপাশে বদ্ধ কক্ষে বইয়ের ভান্ডার। প্রায় ১৫ বছর ধরে নেই কার্যক্রম। ছবি : মাহমুদুল হাসান মুক্তা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, জামালপুর
বাংলারচিঠি ডটকম

লাইব্রেরি পরিচালনা কমিটির নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার কারণে জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী ও বহুমূল্যবান দেশি-বিদেশি বইয়ের সমৃদ্ধ ভান্ডার এবং এক সময়ের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সূতিকাগার জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরি দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে অচল রয়েছে। তাকে থাকা ১৮ হাজার বইগুলোও পোকায় খাচ্ছে এবং ঢেকে যাচ্ছে ধুলোবালিতে।

জানা গেছে, ১৯৫৯ সালে জামালপুর পৌরসভার পাবলিক হলের একটি কক্ষে ‘জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরি’ নামে এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে শহরের বকুলতলায় বর্তমান স্থানে ২৯ শতাংশ জমিতে নিজস্ব পাকা ভবনে এর কার্যক্রম শুরু হয়।

শুরু থেকেই জামালপুরের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণ কেন্দ্র ছিল এই লাইব্রেরি। পাঠকদের বই লেন-দেন, বই মেলা আয়োজন, সারা বছর ধরেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে দীর্ঘদিন বেশ সচল ছিল। প্রতিদিন শতাধিক পাঠক সদস্যরা এখান থেকে বই নিতেন, জমা দিতেন। একজন গ্রন্থাগারিক ও একজন কর্মচারীকে সেইসব বই বইয়ের তাকে গুছিয়ে রাখতে সময় দিতে হতো মধ্যরাত পর্যন্ত। বিকেল হলেই উন্মুক্ত পাঠকদের জন্য সংবাদপত্র পড়তে ভিড় জমে যেতো। গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ এবং বিভিন্ন চাকরি প্রত্যাশীদের চাকরির বিজ্ঞাপন ও তথ্য সংগ্রহ করতে একসময় এই পাবলিক লাইব্রেরির সংবাদপত্রগুলোই ছিল ভরসাস্থল।

সরকারি-বেসরকারি অনুদানে লাইব্রেরিতে রয়েছে ১৮ হাজার বই। দেশি-বিদেশি মূল্যবান এসব বই পাঠকদের জন্য এক বিশাল জ্ঞানভান্ডার বলা হয়ে থাকে। লেখক ও পাঠকদের গবেষণার কাজে এই লাইব্রেরিটির সহায়ক গুরুত্বও রয়েছে অনেক। সর্বশেষ তথ্যানুসারে এই লাইব্রেরিতে ২৪৫ জন ছাত্র পাঠক সদস্য, ২৪৯ জন সাধারণ পাঠক সদস্য এবং ১৭৫ জন আজীবন পাঠক সদস্য রয়েছেন। কিন্তু কার্যক্রম বন্ধ থাকায় দিনে একজন পাঠকও সেখানে উঁকি দেন না।

বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে বলা যায় বন্ধই হয়ে গেছে এই লাইব্রেরির কার্যক্রম। মূলত: এই লাইব্রেরির ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটির নিষ্ক্রিয়তার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে। বর্তমানে খুবই সামান্য বেতনে এখানে কর্মরত আছেন একজন গ্রন্থাগারিক ও একজন পিয়ন। তাদের বেতন তো বাড়ানো হয়ই নাই, প্রায় সাত বছর ধরে তারা বেতনও পান না। ছয়টি দৈনিক পত্রিকা পড়ে থাকে টেবিলের ওপর। পড়ার পাঠক নেই। পত্রিকা ও বিদ্যুতের বকেয়া বিলের পাহাড় জমে গেছে।

পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বই রাখার কক্ষের দরজায় তালা ঝুলছে দীর্ঘদিন ধরে। চারদিকে জানালা খোলা হয় না। ভেতরে বৈদ্যুতিক ফ্যান চালু রাখা হয় না। তাকে রাখা বইগুলো ধুলোবালিতে ঢেকে যাচ্ছে। তাকে রাখা বইগুলোও নষ্ট হতে চলেছে। কোনো কোনো তাকে উঁইপোকায় বাসা বেঁধেছে। তাক সঙ্কটের জন্য অনেক বই ও নথিপত্র দেয়ালের কোণায় মাটিতে ঢিবি করে রাখার কারণে সেই বইগুলোও নষ্ট হচ্ছে।

লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক শ্যামল চন্দ্র দাস বলেন, কমিটির লোকজন এখানে নজর না দেওয়ায় আমরা দু’জন কর্মচারী খুবই সমস্যায় আছি। মাঝে মধ্যে খুলে পরিষ্কার করি। ফ্যান ঘুরাই। আলোবাতাস দেই।

জামালপুরের প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জামালপুর পাবলিক লাইব্রেরির টানা কয়েকবারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নিষ্ক্রিয় কমিটির সহসভাপতি সুকুমার চৌধূরী বলেন, আমার সময়ে এই পাবলিক লাইব্রেরি পুরোদমে সচল ছিল। এই লাইব্রেরিই ছিলো জামালপুরের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সূতিকাগার। আমার জীবনের অনেক মূল্যবান সময় ও শ্রম এই লাইব্রেরিতে ব্যয় করেছি নি:স্বার্থভাবে। বিগত ২০০৪ সালে তিন বছর মেয়াদি নতুন কার্যকরি কমিটি হয়। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও আজও নতুন কমিটি হয়নি। কমিটির নিষ্ক্রিয়তায় প্রায় ১৫ বছর ধরে এখানে কোনো কার্যক্রম নেই। অনেক মূল্যবান বই সংগ্রহ করে সব বই ক্যাটালগিং করে রেখে এসেছি। নতুন কমিটি গঠন করে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিলে লাইব্রেরিটিকে সচলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।’

মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির ভোটে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক বিএনপিনেতা ও সাবেক পৌর মেয়র শাহ মো. ওয়ারেছ আলী মামুন এ প্রসঙ্গে বাংলারচিঠি ডটকম বলেন, আমি টানা দুইবার পৌর মেয়র থাকা অবস্থায় চেষ্টা করেছি লাইব্রেরিটি সচল রাখতে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে কমিটির অন্যান্য সদস্যদের অসহযোগিতার কারণে লাইব্রেরিটি চালু রাখতে একটু সমস্যা হয়। এই ধরনের প্রতিষ্ঠান একার পক্ষে সচল রাখা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।

মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির পদাধিকার বলে সভাপতি জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর এই লাইব্রেরি প্রসঙ্গে বাংলারচিঠি ডটকমকে বলেন, খুব শিগগির লাইব্রেরির কমিটি পুনর্গঠন করাসহ পুরোদমে চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় সবরকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।