দিন দিন কমছে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেঞ্চ ফাঁকা পড়ে থাকলেও কিন্ডার গার্টেন, প্রিক্যাডেট ও মাদরাসার শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
শিক্ষাক্রমে আস্থাহীনতা এবং শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি পরিদর্শনসহ দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষার্থী ঝরেপড়ার হার বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে মাদরাসা, কিন্ডার গার্টেন ও প্রিক্যাডেট বিদ্যালয়ে দিনদিন শিক্ষার্থী উপচে পড়ছে।
শিক্ষার্থীদের টানা অনুপস্থিতে শিক্ষকদের খোঁজ না রাখা, প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে পাঠদান, অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের যোগাযোগ না থাকাসহ প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের কর্তব্যে ব্যাপক অবহেলা ও উদাসীনতাকে দায়ী করছেন অভিভাবকেরা। দু’টি নদ-নদী দ্বারা তিন ভাগে বিভক্ত উপজেলার যমুনার দুর্গম চরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে প্রশিক্ষণহীন অনভিজ্ঞ প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে পাঠ্দান করায় শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে পাঠদানে কাঙ্খিত পাঠদান, পাশাপাশি সঠিক পাঠ্য কারিকুলাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে খুদে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নগণ্য, সারি সারি বেঞ্চ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। উপস্থিতি হতাশাজনক। উপজেলার যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলের দিঘাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৬৫ জন শিক্ষার্থীর স্থলে ছয়জন, উত্তর দিঘাইর সপ্রাবি ৯৭ জন শিক্ষার্থীর স্থলে চারজন, দক্ষিণ বরুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৪২ জন শিক্ষার্থীর স্থলে সাতজন, জিগাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৪০ জনের স্থলে ছয়জন, চর বরুল, চর দিঘাইর , সাপধরী, চেঙ্গানীয়া, কাশারীডোবা, চরনন্দনের পাড়, সিন্দুরতলী বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে হাতে গোণা দু-তিনজন শিক্ষার্থী থাকলেও প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে পাঠদান ও শিক্ষকদের নিয়মিত না আসার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও চরশিশুয়া, উত্তর জোরডোবা, শিলদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীশুণ্য তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে।

পূর্বাঞ্চলের পূর্ব পোড়ারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮৯ জন শিক্ষার্থীর স্থলে চারজন, হাসানপুরে ৮৯ জন শিক্ষার্থীর স্থলে ছয়জন, নান্দেকুড়া মন্ডলবাড়ি, সভারচর, দক্ষিণ মোহাম্মদপুর, সাজলেরচর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দুই থেকে তিনজন শিক্ষার্থী উপস্থিতি থাকলেও হরিণধরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থীশূন্য ও মোহাম্মদপুর বালুচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দু’জন শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থীশূন্য দেখা গেছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩৫টি কিন্ডার গার্টেন ও জাতীয়করণ প্রস্তাবিত ৯৮টি এবতেদায়ি মাদরাসা ও ২৫টির মত কওমি মাদরাসা রয়েছে।
দুর্গম যমুনার চর জিগাতলার রাশেদুজ্জামান বলেন, শিক্ষকেরা মাসে এক-দু’বার আসেন। বিদ্যালয়ে কোন লেখাপড়া হয় না। আমাদের এই চর জিগাতলা থেকে শিলদহ পর্যন্ত প্রক্সি শিক্ষক দিয়েই চলে। অনেক বিদ্যালয়ে প্রক্সি শিক্ষকও নেই। শিক্ষকও তেমন আসেন না। অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে যমুনার চরের বিদ্যালয়গুলো।
দুর্গম যমুনার চরের আজিজ মিয়া বলেন, আমার বুঝমান হইছি নাগাদে দেখছি চরাঞ্চলে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের দ্বায়িত্বহীনতা। তেমন কোন নজর নেই উর্ধ্বতন শিক্ষা কর্মকর্তাদের। অনেক অভিযোগ দিয়েছি কোন কাজ হয়নি। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে পাঠদান পরিচালনা করছেন শিক্ষকেরা। উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর করে শিক্ষকেরা শুধু বেতন-ভাতাদি তুলেন নিয়মিত।
স্থানীয়রা আরও জানান, যমুনার চরের অন্যান্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর একই অবস্থা। শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে দায় সারতে আসেন। করোনার পর থেকে শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। দিন দিন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চরাঞ্চলের কোমলমতি শিশুরা। পূর্বাঞ্চলের অভিভাবক এরশাদ আলী বলেন, উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়ায় আমরা উদ্বিগ্ন ও হতাশা। পূর্বাঞ্চলের রাস্তাঘাট উন্নত হওয়ায় ভাল লেখাপড়ার জন্য সদরে কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়াতে হচ্ছে। শিক্ষার এই অবহেলা থেকে পরিত্রাণ পেতে দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
এদিকে, শিক্ষকেরা যমুনা চরের স্কুল নৌকায় যাতায়াতে মাঝে মাঝে একটু সমস্যা হয় বলে জানান। এছাড়াও প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন নূরানি ও এবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপিত হওয়ায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ার কারণ বলেও উল্লেখ করেন।
দীঘাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নুরুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, একদিকে নদী ভাঙন। অন্যদিকে অভিভাবকেরা অসচেতন। পাশাপাশি দুই পার্শেই দুটি মাদরাসা হওয়ায় উপস্থিতি কমে গেছে। সহকারী শিক্ষক ইউসুফ আলী বলেন, অভিভাবকদের চাহিদা কম। তারা শিশুদের বাড়িতেই কাজ করান। স্কুলে পাঠান না। কারণ হিসাবে তিনি পাশের মাদরাসাগুলোকে দায়ী করেন।
অভিভাবক নজরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন তেমন লেখাপড়া হয় না। বিদ্যালয়ে ছাত্ররা একটানা কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকলেও শিক্ষকেরা খোঁজ নেন না। অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের কোন যোগাযোগ নেই। মাওলানা আব্দুল খালেক বলেন, আরবি শিক্ষার প্রতি সবারই আগ্রহ রয়েছে। আগ্রহ থেকেই দিনদিন এ শিক্ষা নিতে শিক্ষার্থী সংখ্যার বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদরাসাগুলোতে।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহানারা বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, শিক্ষার্থী আগের তুলনায় এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও বিদ্যালয়গুলো প্রতিনিয়তই পরিদর্শন করা হচ্ছে। তবে প্রক্সি শিক্ষকের বিষয়ে আমার জানা নেই। এ ধরনের কাজ কোন বিদ্যালয় করলে তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লিয়াকত হোসাইন লায়ন : নিজস্ব প্রতিবেদক, ইসলামপুর, বাংলারচিঠিডটকম 


















