‘তাবিজ নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড’

বশিকরণ তাবিজদাতা ইমাম সাইফুল (ডানে) ও তাবিজগ্রহীতা জামাল (বামে)। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় একটি তাবিজকে কেন্দ্র করে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটেছে। ঘটনার শুরু উপজেলার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কিশোরীর ভালোবাসা পেতে তাকে তাবিজ দিয়ে বশিকরণ নিয়ে। অভিযোগ ওঠেছে, এক কিশোর ওই কিশোরীকে তাবিজ করে বশে আনতে স্থানীয় ইমামের শরনাপন্ন হয়। এক পর্যায়ে কিশোরী গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়লে এ ঘটনা জনসন্মুখে আসে।

আর এ তাবিজ নিয়ে একপক্ষ আরেক পক্ষের বাড়ি ঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায়। চলে মারধরের ঘটনা, মিমাংসার জন্য স্থানীয়ভাবে দফায় দফায় বসে বিচার-শালিশের বৈঠক। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া হয় নানা ভিডিও বার্তা। শুধু তাইনা এ বিষয়টিকে ধর্মীয় ইস্যুতে নিয়ে গিয়ে এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। শেষ পর্যন্ত ২৪ এপ্রিল এ নিয়ে থানা পুলিশে পৃথক দুটি অভিযোগ দায়ের করা হয়।

২৫ এপ্রিল দুপুরে এ খবর লেখার সময় নালিতাবাড়ী থানার ওসি বাছির আহমেদ বাদল বলেন, তিনি এ ঘটনা তদন্ত করতে ওই কিশোরীর বাড়ীতে অবস্থান করছেন। এছাড়া সম্পূর্ণ ঘটনা তদন্ত শেষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, গত চার মাস আগে উপজেলার বুরুঙ্গা গ্রামের জনৈক এক ব্যক্তির কিশোরী কন্যাকে প্রেমের জালে আটকাতে তাবিজ দিয়ে বশিকরণ করতে পার্শ্ববর্তী আন্ধারুপাড়া গ্রামের শান্তির মোড় মসজিদের ইমাম সাইফুল ইসলামের সাথে ৫০০ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয় ওই কিশোরীর ফুফাতো ভাই জামাল। ওই কিশোরী স্থানীয় বেগম রৌশন আরা একাডেমির অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

এক পর্যায়ে কিশোরী বশিভূত হওয়ার পরিবর্তে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। নানা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলে স্বজনরা তাকে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। শেষে গ্রাম্য এক কবিরাজের শরণাপন্ন হলে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ওই কিশোরীর অভিভাবক স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আজাদ মিয়ার কাছে নালিশ করলে আজাদ মিয়া স্থানীয় ইউপি সদস্য নূরুল ইসলাম, মসজিদ কমিটির ক্যাশিয়ার বাছির উদ্দিনসহ কয়েকজনকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দায়িত্ব দেন।

পরে ২৪ এপ্রিল দুপুরে বারোমারী বাজারে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে এ নিয়ে গ্রাম্য শালিশ বসে। শালিশে কিশোর জামাল তাবিজের কথা স্বীকার করার একপর্যায়ে মসজিদের ইমাম সাইফুল ইসলামও বিষয়টি স্বীকার করেন। পারিবারিক সম্মান রক্ষায় এ নিয়ে আর হৈচৈ না করে পাল্টা তাবিজের মাধ্যমে কিশোরীকে সুস্থ করার অঙ্গীকার করেন ইমাম সাইফুল। পরে একটি লিখিত অঙ্গীকারনামা তৈরি করে সাইফুলের পিতা, ইউপি সদস্য, মসজিদ কমিটির ক্যাশিয়াসহ স্থানীয় লোকজনের জিম্মায় এক সপ্তাহের সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

এর কিছুক্ষণ পর ইমাম সাইফুল ইসলাম চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেন, তাকে গোপন কক্ষে নিয়ে চড়থাপ্পড় মারা হয়েছে। মুহূর্তেই চেয়ারম্যানের প্রতিপক্ষ বিষয়টি নিয়ে বারোমারী বাজারে উত্তেজনাকর পরিবেশ তৈরি করে। শালিশে উপস্থিত লোকেদের বাড়িঘরে গিয়ে হামলা করে জিম্মি করে রাখে। হামলা করতে উদ্যত হয় তারা। এসময় আশপাশের বাড়িতে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করেন শালিশকারীরা। আশপাশের ইমাম-আলেমসহ প্রতিপক্ষের লোকজন জড়ো হতে থাকে বারোমারী বাজার ও শান্তির মোড়ে।

এদিকে, ওই রাতেই শালিশে উপস্থিত ও হামলার শিকার বাছির উদ্দিন বাদী হয়ে ইমামের সমর্থনকারীদের বিরুদ্ধে বাড়িঘরে হামলার অভিযোগ এনে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অন্যদিকে ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও শালিশে উপস্থিত চারজনকে অভিযুক্ত করে পাল্টা অভিযোগ দায়ের হয়।

ইমাম সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি কোন তাবিজ করিনি। মিথ্যা অভিযোগ তোলে চেয়ারম্যান তাকে গোপন কক্ষে নিয়ে গিয়ে টুটি চেপে ধরে আমার গালে থাপ্পড় দিয়েছেন।

তবে কিশোর জামাল জানায়, তার কথামতো ইমাম সাইফুল ৫০০ টাকার বিনিময়ে তাকে বশিকরণের তাবিজ বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাবিজ উল্টো রি-এ্যাকশন করায় ইমাম সাইফুল পুনরায় তাবিজ দিয়ে ঠিক করার কথা দিয়েছেন।

মসজিদ কমিটির ক্যাশিয়ার ও শালিশকারী বাছির উদ্দিন জানান, সবার সামনে ইমামের দোষ প্রমাণিত হয়েছে, তিনি স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন। কিন্তু বেরিয়ে গিয়ে পাল্টা অভিযোগ তোলে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং ধর্মীয় ইস্যু বানিয়ে আমার বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আজাদ মিয়া বলেন, চড়থাপ্পড়রের কোন ঘটনাই ঘটেনি। ইমাম সাহেব নিজের অপকর্ম আড়াল করতে এখন পাল্টা অভিযোগ তোলছেন। অথচ অঙ্গীকারনামায় তার দোষের কথা উল্লেখ করে তাকে জিম্মায় নিয়েছে তারই পিতাসহ গণ্যমান্যরা।

অপরদিকে, ইমাম চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চড়থাপ্পড়ের অভিযোগ এনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভিডিও বার্তা ছড়িয়ে দেন। ঠিক এর পরপরই শালিশ বৈঠকে ইমামের নিজের মুখের তাবিজ করার স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করেন শালিশে উপস্থিতরা।

এ সম্পর্কে উপজেলা ইমাম সমিতির সভাপতি হাজী জামাল উদ্দিন বলেন, কোন ঘটনা হয়ে থাকলে চেয়ারম্যান আজাদ মিয়া আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। কি হয়েছে ভুল ত্রুটি সত্য জেনে বিষয়টি বুঝে সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেয়া যেত।