প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসন এত ভালো তা জানা ছিল না

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসন এত ভালো তা আমার জানা ছিল না। এ কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মী সানোয়ার হোসেনের স্ত্রী তাসলিমা। এখন তার সংসারে শিশুসহ চারজন করোনায় আক্রান্ত। তার বাড়িতে করোনা আক্রান্ত রোগী থাকায় আশপাশের প্রতিবেশীরা ঢিল ছুঁড়তো। আর নানা ধরনের বাজে উক্তি করে নাজেহাল করতো। বাইরে বের হতে না পারায় ঘরে দেখা দেয় খাদ্য ও ওষুধ সংকট। তাসলিমা বলেন, এ জীবনে হয়ত কোন একটা ভালো করেছিলাম যে কারণে আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুলিশ প্রশাসনের সদস্যরা আমার এ মহাবিপদে পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি খাদ্য ও ওষুধপত্র দিচ্ছেন তারা।

একাধিক সূত্র জানায়, বিদ্যুতকর্মী সানোয়ার ঢাকার পল্টন শাখায় হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনি দীর্ঘদিন শেরপুর পিডিপি কর্মচারি ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি ছিলেন।

সিভিল সার্জন চিকিৎসক আনোয়ারুর রউফ জানান, করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেল ১৬ জুন ভোর রাতে তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে জেলা সদর হাসপাতালে তিনি মারা যান। তার বাড়ি শেরপুর শহরের বাগরাকসার কাজী বাড়ি এলাকায়। সানোয়ারের মৃত্যুর পর তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের কাছ থেকে করোনা নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরদিন ১৭ জুন রাতে হাতে পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী ওই নমুনাগুলোর মধ্যে চারজন করোনা শনাক্ত হন। এখন তারা নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন। এছাড়া বাড়িটি লকডাউন করা হয়েছে।

১৮ জুন বিকালে ওই বিদ্যুতকর্মীর স্ত্রী তাসলিমার সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এ সময় তিনি জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সাহায্য ও সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এবং করোনায় আক্রান্ত সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হন।

তাসলিমা জানান, তার স্বামী যখন করোনা শনাক্ত হয়ে নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে ছিলেন তখন প্রতিবেশীরা তাদের ঘরে ঢিল ছুঁড়তো। নানা ধরনের বাজে উক্তি করে নাজেহাল করতো। পরে বিষয়টি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুনকে জানানো হয়। এর পরপরই তিনি এলাকায় এসে স্থানীয়দের উত্ত্যক্ত করতে নিষেধ করেন। এবং তাদের খোঁজ খবর নেন।

তাসলিমা বলেন, এখন তার পরিবারের যমজ দুই মেয়ে তানহাত (১৪), তাশমি (১৪), ছেলে তানভির অনিক (২১) এবং ছোট বোন ফারহানা ববি (৩৩) করোনায় আক্রান্ত। এছাড়া তিনি নিজেও ডায়াবেটিস, থায়রয়েড, গলাব্যাথা ও প্রচন্ড মানসিক চাপে ভুগছেন। তার দুই মেয়ে এখনও জানেনা তাদের বাবা আর বেঁচে নেই। তারা দু’জন বারবার বাবার কথা জানতে চাইছে। উত্তরে ওদেরকে বলেছি তাদের বাবাকে সরকারি খরচে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সুস্থ হলেই ফিরে আসবে। এ কথা বলে তাসলিমা অঝোর ধারায় কান্না করতে থাকেন। বলেন সত্য বলার শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তায় আর ঘুম আসছে না। দিন যাচ্ছে আর ওদেরও শরীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছেলে মেয়েদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

তাসলিমা আরও বলেন, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তানদের সাথে নিয়েই বাঁচতে চাই। যদি মরে যাই তাহলে সন্তানদের দেখাশুনার দায়িত্ব যেন প্রশাসন নেয়। আর যদি আমরা সবাই মারা যাই তাহলে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সঠিকভাবে সবার সৎকারের ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে অবেদন জানান তিনি।

ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুনের জন্যই এখন পর্যন্ত তারা বেঁচে আছেন জানিয়ে তাসলিমা বলেন, আত্মীয় স্বজনরা তেমন খোঁজ নিচ্ছে না। আর আমরাও ঘরের বাইরে বের হতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে ওসি সাহেব আনুসাঙ্গীক ওষুধপত্র ও নানা ধরনের খাবার বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন। যা দিয়ে আমার সন্তানরা এখনও বেঁচে আছে। তিনি প্রতিদিন ফোন করে খবর নিচ্ছেন। এবং নিরাপত্তার জন্য দিনে দুইবার করে পুলিশের গাড়ি বাড়ির চারপাশে টহল দিচ্ছে। এছাড়া পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বিভিন্ন সময়ে ফোন করে খবর নিচ্ছেন।

তার (তাসলিমা) ওইসব বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায় ওসি’র ত্বরিৎ পদক্ষেপে ডায়াবেটিক পরিমাপের গ্লোকমিটার স্টিপ দ্রুততম সময়ে সরবরাহের মাধ্যমে।

ঘটনাটি এমন এ প্রতিবেদক যখন তাসলিমার সাথে পরিবারের চার সদস্যের করোনা আক্রান্তের বিষয়ে ফোনে কথা বলছিলেন এ সময় তাসলিমা প্রতিবেদকের কাছে ডায়াবেটিক পরিমাপের গ্লোকমিটার স্টিপ সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ জানান। এর পরপর প্রতিবেদক জেলা ডায়াবেটিক সমিতির সভানেত্রী ও সমাজ সেবক রাজিয়া সামাদ ডালিয়ার সাথে যোগাযোগ করেন। এ তথ্য ওসি মামুনের কাছে পৌঁছানোমাত্র তিনি নিজ উদ্যোগে খুব অল্প সময়ের মধ্যে গ্লোকমিটার স্টিপ তাসলিমার হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

রাজিয়া সামাদ ডালিয়া বলেন, আমি তাসলিমার ছেলে করোনায় আক্রান্ত তানভির অনিকের সাথে কথা বলেছি। তাকে আশ্বস্ত করেছি তাদের যে কোন সাহায্য সহযোগিতা ও প্রয়োজনে পাশে থাকবো।

সানোয়ার হোসেনের ছেলে তানভির অনিক করোনা শনাক্ত হওয়ার পর ১৭ জুন নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন। সেখানে অনিক লেখে, মাননীয় পুলিশ সুপার ও মাননীয় ওসি সাহেব আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। আমি ও আমার মা হাসপাতালে থাকা মুহূর্তে আমাদের পরিবারের যেসব সদস্যরা বাসায় ছিলেন তাদের জন্য খাদ্যসামগ্রী, ফলমূল ও খোঁজখবর নিতেন। এমনকি হাসপাতালেও আমাদের জন্য খাবার ও পানির ব্যবস্থা করতে ওসি সাহেব নিজে এসেছিলেন। ধন্যবাদ দিয়ে জেলা পুলিশকে ছোট করবো না। আমি ও আমার পরিবার তাদের কাছে ঋণী। বিশেষ করে ওসি সাহেবের ভূমিকা আমরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখবো। আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন। বর্তমানে আমাদের শারীরিক অবস্থার অবনতির দিকে। আশাকরি সুষ্ঠু চিকিৎসা পাবো ও আল্লাহর রহমতে সবাই সুস্থ হয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, মানবিক পুলিশের চোখে, জনতার আকাঙ্খা লেখা থাকে এই শ্লোগানকে সামনে রেখে কাজ করছে জেলা পুলিশ। আর সেই নৈতিক দায়িত্ববোধের তাগিদে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে ওই করোনা আক্রান্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং করোনাভাইরাস সম্পর্কিত তথ্য নিশ্চিতকারী চিকিৎসক মোবারক হোসেন জানান, ওই চার করোনা শনাক্ত রোগীকে চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে তাদেরকে গরম পানি পান এবং গারগল করতে বলা হয়েছে। এছাড়া টক জাতীয় খাবার খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ঘরের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং প্রত্যেককে আলাদা বাথরুম ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।

১৭ জুন ওই চারজন করোনা শনাক্ত হন। চিকিৎসা চলাকালিন অবস্থায় সাতদিন পর পুনরায় তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হবে বলে জানান তিনি।