সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প অকেজো, শেরপুর সীমান্তে হাতির আক্রমণের শঙ্কায় দুই লক্ষাধিক মানুষ

লোকালয়ে হাতি প্রবেশের পরপরই সোলার ফ্যান্সিং এর এই বাক্সে রাখা যন্ত্রের মাধ্যমে সাইরেন বাজানো হতো। প্রকল্পটি ভেস্তে যাওয়ায় যন্ত্রপাতি শূন্য বাক্স। ছবিটি ঝিনাইগাতী থেকে তোলা। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

শেরপুরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বুনো হাতি তাড়ানোর সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প। জেলার তিনটি উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণকে হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সরকার এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছিল। স্থানীয়রা বলছেন, শুরুর দিকে ওই প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া গেলেও সুষ্ঠু তদারকির অভাবে এখন সোলার ফ্যান্সিংগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। যে কারণে ওইসব এলাকার দুই লক্ষাধিক মানুষ এখন যে কোন সময় হাতির তান্ডবের আশঙ্কায় রয়েছেন। ওই সোলার ফ্যান্সিংটি সচল করতে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন জানানো হলেও এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। এটি পুনরায় চালু করতে অর্থ সংস্থানের জন্য বাজেট তৈরি করার কাজ চলমান আছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

জেলা বন বিভাগ ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ভারতের মেঘালয় রাজ্যর অরণ্যে বাসকারি বুনো হাতির পাল প্রতি বছর খাদ্যের সন্ধানে শেরপুরের সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোতে বিভিন্ন সময়ে হানা দেয়। এ কারণে হাতিগুলোর উপদ্রুবে সব সময় অতিষ্ঠ থাকে সীমান্তবাসীরা। তাই সফল বাঁচাতে শুরু হয় হাতি মানুষের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে কখনও মানুষ বা কখনও হাতি মারা পড়ে। আর এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার অন্য দেশগুলোর আদলে সীমান্ত এলাকার ১৩ কিলোমিটার জুড়ে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে তার দিয়ে বেড়া নির্মাণ করে। এর ফলে হাতি লোকালয়ে প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে সোলার ফ্যান্সিংটি সচল করে দেওয়া হতো। এ সময় হাতির দল বৈদ্যুতিক তারে শক খেয়ে ভয়ে লোকালয়ে ঢুকার চেষ্টা করত না। সোলার ফ্যান্সিংটিতে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এ থেকে প্রবাহিত বিদ্যুতের তারে হাতি সংস্পর্শে এলেও কোন ক্ষতি হবেনা। কোন বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিউ ন্যাশন সোলার লিমিটেড।

ঝিনাইগাতীর গজনী এলাকার কৃষক প্রফুল্ল মারমা বলেন, প্রকল্পটি বস্তবায়নের পর কিছুদিন তারা এর সুফল পান। কিন্তু দিন গড়াতে থাকায় সোলার ফ্যান্সিং এর এনার্জিজার, সোলার প্যানেল, ব্যাটারি, চার্জ কন্ট্রোলার ও ফ্যান্স অ্যালার্ম বিকল হয়ে যায়। এছাড়া প্রকল্পে ব্যবহৃত সকল তারের বেড়া ছিঁড়ে যায়। পাশাপাশি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সুষ্ঠু তদারকির অভাবে এটি এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে তার দাবি।

সোলার ফ্যান্সিং এর খুঁটির তারে লতাপাতা জড়িয়ে প্রকল্পের বেহাল অবস্থা। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

শ্রীবরদী ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, জেলার শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ি অঞ্চলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় ও বাঙালি মিলে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষের বাস। ভারতের বনাঞ্চল থেকে লোকালয়ে চলে আসা বুনো হাতির তান্ডব রুখতে গিয়ে ১৯৯৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত হাতির আক্রমণে প্রায় ৮০-৯০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০০ একর জমির ফসল। অনাবাদি রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমি। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোটি টাকা ব্যয়ে সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সরকার।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্পটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। যে কারণে সীমান্তবাসীরা হাতির আক্রমণের শঙ্কায় থাকে প্রতিনিয়ত।

শ্রীবরদীর একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, উপজেলার রানীশিমুল ও সিংগাবরুনা ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা বাবেলাকোনা, চান্দাপাড়া, দিঘলাকোনা, কুমারগাতি, পানবাড়ি, হারিয়াকোনা, মালাকোচা, বালিজুরি, খারামোরা এলাকা বুনো হাতির বিচরণ ক্ষেত্র। প্রতি বছর ভারতের অরণ্য থেকে নেমে আসা বুনো হাতির পাল খাদ্যের সন্ধানে ওইসব এলাকায় হানা দেয়। বিশেষ করে ইরি, বোরো ও আমন মৌসুমে হাতির আনাগোনা বেড়ে যায়। পাঁকা ধান খেতে ফসলের মাঠে হামলে পড়ে হাতির দল। এছাড়া কাঁঠাল, কলা, লাউ, চাল কুমড়া ও বরবটিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি বাগানে প্রবেশ করে ওইসব সবজি খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে হাতির পাল।

প্রতিটি হাতির পালে ৪০-৫০টি করে হাতি থাকে। ওইসব হাতিরা লোকালয়ে ঢুকে এ পর্যন্ত প্রায় সহস্রাধিক মানুষের বাড়ি ঘর ধ্বংস করেছে বলে তিনি জানান। তাই হাতির আক্রমণ থেকে জানমাল রক্ষা করতে সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প সচল করা অতি জরুরী বলে তিনি মনে করেন।

মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ায় গ্রামবাসীরা। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

জনাদন বনোয়ারী (শহীদ মাস্টার) বলেন, পাহাড়ি এলাকায় কাঁঠাল পাঁকতে শুরু হওয়ায় হাতির দল এখন প্রতিদিন লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। সোলার ফ্যান্সিংগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হাতিরা লোকালয়ে অবাধে বিচরণ করছে। এলাকাবাসী এখন দিনে ও রাতে সমানভাবে আতংকগ্রস্ত থাকে। ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচা, দুধনই, ছোট গজনী, বাকাকুড়া, গজনী, গান্ধীগাঁও এবং বর্ডার রোড এলাকার লোকজন এখন রাতের বেলা খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হয় না বলে তিনি জানান।

ঝিনাইগাতীর ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নবেশ খকশি বলেন, সোলার ফ্যান্সিং নষ্ট হয়ে গেছে বেশ কিছু দিন আগে। ফলে সীমান্ত এলাকায় বাসকারি লাখ লাখ মানুষ আতঙ্কের মধ্যে আছে। এ প্রকল্পটি আবারও চালু করতে স্থানীয় সাংসদ, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত ওই বিষয়ে কেউ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি।

সোলার ফ্যান্সিং অকেজো থাকার কথা স্বীকার করে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল মাহমুদ বলেছেন, প্রকল্পটি পুনরায় চালু করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে প্রকল্পটি রিপেয়ারিং এর জন্য বাজেট তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের শেরপুর অঞ্চলের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) প্রশান্ত কুমার।