করোনা ও মানবতা

পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম পিপিএম

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

জনসাধারণকে সচেতন করতে নো মাস্ক, নো মেডিসিন। মাস্ক নাই যার, বাজার নাই তার কর্মসূচী। হতদরিদ্র কৃষকদের ধান ও ভুট্টা মাঠ থেকে সংগ্রহ করে ঘরে তুলে দেওয়া। করোনার কারণে কর্মহীনদের বাড়িতে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছানো। করোনা শনাক্ত রোগীর বাড়িসহ আশপাশের লকডাউন থাকা বাড়িতে খাদ্য সরবরাহ। সীমান্তের গারো পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অর্থ ও খাদ্য দিয়ে সহায়তাসহ নানা ধরনের প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে শেরপুর জেলা পুলিশ। আর এসব কাজের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম পিপিএম। অন্যদিকে সুবিধাভোগীরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে খেটে খাওয়া, হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশ মানবিকতার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে।

শেরপুরের নকলা উপজেলার ভুরদী খন্দকারপাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, করোনা আতংকে অনেক চাষি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কি না এ নিয়ে শংকায় ছিলেন। পরে পুলিশ সুপার ধান কাটা উৎসব কর্মসূচী হাতে নেন। এর আওতায় পুলিশ সদস্যরা দরিদ্র চাষিদের ফসলের মাঠে গিয়ে ধান কেটে ঘরে তুলে দিচ্ছে। এ কর্মসূচী সদর উপজেলাসহ নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলায় চলমান রয়েছে। বিনা খরচে ধান ঘরে তুলতে পেরে খুশি কৃষকরা। শুধু তাই না করোনা শনাক্ত রোগীর বাড়িসহ আশপাশের লকডাউন থাকা বাড়িতে খাদ্য সরবরাহ করেছে পুলিশ। এছাড়া করোনা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে শহর ও গ্রামগঞ্জে ঘুরে প্রচারপত্র বিলি করে যাচ্ছে পুলিশ। মানুষকে সচেতন করতে পুলিশ যা করে যাচ্ছে তা বলে শেষ করা যাবে না।

এ সময় তিনি পুলিশ সুপারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আসছে ঈদে অনেকেই কেনাকাটা করার জন্য দল বেঁধে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। যা করোনা প্রতিরোধের অন্তরায়। জনসমাগম কমাতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পুলিশের কঠোর ভূমিকার দাবি জানান তিনি।

মোশারফ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫০ লাখ হতদরিদ্র ও কর্মহীন পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দিবেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে মে এবং জুন- এই দুই মাসে ওই পরিবারগুলো পাঁচ হাজার টাকা পাবে।

তার ধারণা, শেরপুরে এ কাজে দুর্নীতি ও কারচুপি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই জেলার পাঁচ উপজেলার এ কর্মসূচী চালু হওয়ার আগে তা পুলিশের মাধ্যমে যাচাই বাছাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান। তিনি মনে করেন, পুলিশই প্রকৃত হতদরিদ্র ও কর্মহীন পরিবারের হাতে ওই টাকা পোঁছে দিবে।

কৃষক নেতা সায়েদুল হক বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ সদস্যরা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সরকারের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রামের হাট বাজারগুলোতে পুলিশ সদস্যরা নজরদারি করে যাচ্ছেন। অনেক সময় তারা বয়স্ক ক্রেতাদের বাজার সদাই তাদের বাড়ি পর্যন্ত পোঁছে দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা দরিদ্র কৃষকের ধান ঘরে তুলে দেওয়ায় স্থানীয় বিভিন্ন ছাত্র ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা তা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। এখন ওইসব সংগঠনের কর্মীরা কৃষকদের সহায়তা করতে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে। পুলিশ এ কাজে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।

সায়েদুল বলেন, আমরাও পুলিশের কাজের সহকারি হিসাবে কাজ করতে আগ্রহী। কারণ বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। তাই পুলিশ সুপারের করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমের সাথে তার সংঠনের সদস্যরা কাজ করার সুযোগ চায়। প্রয়োজনে ওয়ার্ড ও গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামে যুক্ত হয়ে স্বেচ্ছা শ্রমের মাধ্যমে তারা কাজ করতে আগ্রহী। তার সংগঠনে ৬০ জন সদস্য রয়েছে বলে তিনি জানান।

একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহীদুল ইসলাম বলেন, সীমান্তের গারো পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অর্থ ও খাদ্য দিয়ে সহায়তাসহ নানা ধরনের প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে জেলা পুলিশ। করোনা পরিস্থিতিতে খেটে খাওয়া, হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিকতার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন পুলিশ সুপার।

তিনি আরও বলেন, ২০ এপ্রিল সকালে করোনা ভাইরাস ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে শেরপুর জেলার সাথে ভিডিও কনফারেন্স করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ দিন পুলিশ সুপার তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীকে আস্বস্ত করে বলেন, কৃষক যেন তার উৎপাদিত পণ্য ঠিকমতো বাজারজাত করতে পারে এবং ফসল ঘরে তুলতে পারে সেজন্য পুলিশের তরফ থেকে সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া চলতি বোরো মৌসুমের ফসল ঘরে তুলতে কৃষকদেরকে সংগঠিত করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের সাথে সমন্বয় করে কৃষকদের সহযোগিতা করা হবে। এই শিক্ষক মনে করেন প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া কথা রেখেছেন পুলিশ সুপার।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোহিত কুমার দে ১৬ মে সকালে বলেন, কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকরা যেন ক্ষতির শিকার না হন এবং কৃষকরা যেন সময় মতো ফসল ঘরে তুলতে পারে সে চিন্তা থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে জেলা পুলিশ হতদরিদ্র কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তুলে দিচ্ছেন। যা সত্যিই প্রশংসনীয়। এ পর্যন্ত জেলার প্রায় ৫৬ ভাগ জমির ধান কৃষকরা ঘরে তুলেছেন। বাকি ধান সংগ্রহ করতে পুরো মে মাস লাগবে বলে তিনি জানান।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আমিনুল ইসলাম বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বহুমাত্রিক কাজ করে যাচ্ছে। ঝুঁকি নিয়ে মাঠে তারা সক্রিয় রয়েছে। এ ছাড়া জনগণকে সচেতন করতে পুলিশ প্রতিনিয়ত নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। জীবাণুনাশক ছিটানো এবং রোগীদের হাসপাতালেও পৌঁছে দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তিনি জানান, জনসাধারণকে সচেতন করতে নো মাস্ক, নো মেডিসিন। মাস্ক নাই যার, বাজার নাই তার। এ ধরনের প্রচারপত্র ও ব্যানার এলাকার বিভিন্ন মুদি দোকান ও ওষুধ বিক্রেতাদের দোকানের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এ নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করতে দোকান মলিকদের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে। আমরা আছি জনতার পাশে, মানবিক পুলিশের চোখে জনতার আকাঙ্ক্ষা লেখা থাকে এ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে জেলা পুলিশের উদ্যোগে স্থাপন করা হয়েছে করোনা নমুনা সংগ্রহ বুথ।

এছাড়া করোনা ভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে শেরপুরে লকডাউন চলাকালীন দোকান ও শপিংমল খোলা রাখার বিষয়ে একমুখী সড়ক চালুকরণের কাজ শুরু হয়েছে।

তিনি আরও জানান, করোনায় জেলায় তিনজন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে দুইজন সদস্য সুস্থ হয়েছেন। আর অন্য এক সদস্য ঝিনাইগাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন জানিয়ে পুলিশ সুপার আশরাফুল আজীম গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, জেলা পুিলশের পক্ষ থেকে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে মাইকিং, প্রচার-প্রচারণা, লিফলেট বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া কর্মহীন ও অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তার কাজও চলমান রয়েছে।

পুলিশের পক্ষ থেকে ধান কেটে মাড়াই করে কৃষকের ঘরে তুলে দেয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তা দেয়া সহজ হবে। সে লক্ষেই কৃষক যেন সময় মতো ধান ঘরে তুলতে পারে পুলিশের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।