১৬৯ রানের বড় ব্যবধানে জিতলো বাংলাদেশ

বাংলারচিঠিডটকম ডেস্ক: ওপেনার লিটন দাসের সেঞ্চুরিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ১৬৯ রানের বড় ব্যবধানে জিতলো স্বাগতিক বাংলাদেশ। রান বিবেচনায় নিজেদের ওয়ানডে ক্রিকেটে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে ম্যাচ জয়ের নতুন রেকর্ড গড়লো টাইগাররা। বাংলাদেশের আগের বড় জয়টি ছিল ১৬৩ রানের। ২০১৮ সালে ঢাকায় শ্রীলংকার বিপক্ষে ১৬৩ রানে জিতেছিল টাইগাররা। আজ ওই রেকর্ড ভেঙ্গে নয়া রেকর্ড গড়লো মাশরাফি বাহিনী। এই জয়ে তিন ম্যাচ সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।

১ মার্চ সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্বান্ত নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। লিটন দাসকে নিয়ে ইনিংস শুরু করেন তামিম ইকবাল। পাওয়ার প্লেতে ৪৪ রান যোগ করেন তারা। তামিম ধীর গতিতে আগালেও, লিটন রান তোলার কাজ সাড়ছিলেন অবলীলায়।

১৩তম ওভারে লিটন-তামিম বিচ্ছিন্ন হন। প্রথমবারের মত ওয়ানডে খেলতে নেমেই বাংলাদেশকে প্রথম ধাক্কা দেন কিছুদিন আগে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে আসা অফ-স্পিনার ওয়েসলি মাধভেরে। তামিমকে লেগ বিফোর ফাঁদে ফেলে আউট করেন তিনি। বাঁচতে রিভিউ নিয়েছিলেন তামিম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। রিভিউ নষ্ট করে ৪৩ বলে ২টি চারে ২৪ রান করে ফিরেন তামিম।

দলীয় ৬০ রানে প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। দুই ওপেনারের ভালো শুরুটা পরবর্তীতে ধরে রাখে বাংলাদেশ। নাজমুল হোসেন শান্তকে নিয়ে দলের স্কোরবোর্ডকে শক্ত করতে থাকেন লিটন। ১৭তম ওভারে নিজের মুখোমুখি হওয়া ৪৫তম বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন লিটন।

আর ২০তম ওভারের প্রথম বলে বাউন্ডারি দিয়ে দলের স্কোরকে শতরানে পৌঁছে দেন লিটনই। লিটনের সাথে তাল মিলিয়ে রান তুলতে থাকেন শান্তও। তাই ২৫ ওভার শেষে ১৩৪ রানে পৌছে যায় বাংলাদেশের সংগ্রহ।

তবে ২৬তম ওভারে থামতে হয় শান্তকে। লেগ-স্পিনার তিনোতেন্ডা মুতোমবদজিকে সুইপ করতে গিয়ে লেগ বিফোর হন শান্ত। রিভিউ না থাকায় সেটি ব্যবহার করার সুযোগ ছিলো না। ৩৮ বলে ১টি চার ও ২টি ছক্কায় ২৯ রান করেন শান্ত। আউট হওয়ার আগে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে লিটনের সাথে ৭৭ বলে ৮০ রান যোগ করেন শান্ত।

শান্ত ফিরে যাবার পর মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে সামনে এগোতে থাকেন লিটন। ছন্দে থাকা ওপেনার লিটনকেই স্ট্রাইক দিয়ে খেলছিলেন মুশফিক। ৩৪তম ওভারের প্রথম বলে জিম্বাবুয়ের পেসার ডোনাল্ড তিরিপানোকে বাউন্ডারি মেরে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি তুলে নেন লিটন। ক্যারিয়ারের ৩৪তম ম্যাচে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পেতে ৯৫ বল খেলেছেন লিটন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে দুবাইয়ে ভারতের বিপক্ষে ১২১ রানের পর দ্বিতীয় সেঞ্চুরির দেখা পেলেন এই ডান-হাতি ব্যাটস্যান। এরমধ্যে ১৫ ইনিংসে ৩টি হাফ-সেঞ্চুরি ছিলো তার।

লিটনের সেঞ্চুরি পাওয়া ওভারে বিদায় ঘটে মুশফিকের। তিরিপানোর প্রথম শিকার হন তিনি। ২৬ বলে কোন বাউন্ডারি বা ওভার বাউন্ডারি ছাড়া ১৯ রান করেন মুশফিক।

দলীয় ১৮২ রানে মুশফিক ফিরলেও, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে নিয়ে বাংলাদেশের স্কোর ২শ অতিক্রম করান লিটন। ৩৭তম ওভারে ২শ রানে পায় দেয় টাইগাররা। তার আগের ওভারে তিরিপানোকে তিনটি বাউন্ডারি মেরেছিলেন লিটন।

দলের স্কোর ২শ রানে পৌঁছানোর পরই ছক্কা মারেন লিটন। ওই ছক্কারই পরই হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়ে আহত অবসর হিসেবে প্যাভিলিয়নে ফিরেন লিটন। ১৩টি চার ও ২টি ছক্কায় ১০৫ বলে ১২৬ রান করেন লিটন।

লিটন ফিরলে মাহমুদুল্লাহর সাথে জুটি বাঁধেন মোহাম্মদ মিঠুন। দ্রুত রান তোলায় মনোযোগী ছিলেন তারা। তাই ৪৪তম ওভারেই বাংলাদেশের স্কোর আড়াইশ পেরোয়। এতে ৩শতাধিক রান করার পথও পায় তারা। তবে ৪৬তম ওভারে বিদায় ঘটে ২৮ বলে ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ৩২ রান করা মাহমুদুল্লাহর। পঞ্চম উইকেটে মাহমুদুল্লাহ-মিঠুন ৫৭ বলে ৬৮ রানের জুটি গড়েন।

মাহমুদুল্লাহর বিদায়ে স্লগ ওভারকে কাজে লাগানোর সুযোগ পান দীর্ঘদিন পর ম্যাচ খেলতে নামা অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। কিন্তু উইকেটের সাথে সেট হয়ে থাকায় মিঠুনের ব্যাটে রানের চাকা ঘুড়ছিলো বাংলাদেশের। ৪৮তম ওভারের চতুর্থ বলে বাউন্ডারি মেরে ৪০তম বলেই হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করে ফেলেন মিঠুন। ২৫তম ম্যাচে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের পঞ্চম হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন মিঠুন। হাফ-সেঞ্চুরি করার পরের বলেই আউট হন মিঠুন। ৪১ বলে ৫টি চার ও ১টি ছক্কায় সমান ৫০ রান করেন মিঠুন।

মিঠুনের পর ১টি ছক্কায় ৪ বলে ৭ রান করে ফিরেন মেহেদি হাসান মিরাজ। মিরাজ যখন ফিরেন তখন ইনিংসের ৭ বল বাকী ছিলো। দলের রান ছিলো ২৯৮।

শেষ ওভারে আক্রমনে আসেন জিম্বাবুয়ের পেসার ক্রিস্টোফার এমপফু। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম বলে তিনটি ছক্কা মারেন সাইফউদ্দিন। শেষ ওভার থেকে ২২ রান পায় বাংলাদেশ। সাইফউদ্দিন ৩টি ছক্কায় ১৫ বলে অপরাজিত ২৮ রান করেন। অধিনায়ক মাশরাফি কোন বল না খেলে শুন্য রানে অপরাজিত ছিলেন। জিম্বাবুয়ের এমপফু ১০ ওভারে ৬৮ রানে ২ উইকেট নেন।

ব্যাট হাতে শেষ ওভারের টনের্ডো ইনিংসে জিম্বাবুয়েকে ৩২২ রানের টার্গেট দেন সাইফউদ্দিন। ব্যাট হাতে যে মেজাজে শেষ করেছিলেন, বল হাতে নিয়ে ২২ গজে একই মেজাজই দেখান তিনি। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের চতুর্থ বলে জিম্বাবুয়ের ওপেনার তিনাসি কামুনহুকামবের উইকেট উপড়ে ফেলেন সাইফউদ্দিন। ১ রান করে ফিরেন কামুনহুকামবে।

শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেছিলেন আরেক ওপেনার অধিনায়ক চামু চিবাবা ও রেগিস চাকাবা। দু’জনকে জুটিতে ২২ রানের বেশি করতে দেননি সাইফউদ্দিন। ১১ রান করা চাকাবাকে লেগ বিফোর আউট করেন তিনি।

সাইফউদ্দিনের বোলিং তোপে জিম্বাবুয়ে যখন দিশেহারা, এমন সময়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস মাশরাফি ভক্তরা। ইনিংসের নবম ও নিজের দ্বিতীয় ওভারের চতুর্থ বলে চিবাবাকে বিদায় দেন ম্যাশ। মিড-অনে চিবাবার ক্যাচ নেন মাহমুদুল্লাহ। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের পাঁচ ইনিংস পর কোন ব্যাটসম্যানকে নিজের ঝুলিতে ভড়লেন মাশরাফি। আগের ওভারে ১০ রান দিয়ে সমালোচকদের মুখকে সচল করার উপলক্ষ তৈরি করেছিলেন তিনি। কিন্তু চিবাবার উইকেটে স্বস্তি ফিরলো ম্যাশের।

২৩ রানে ৩ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়ে, ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। অভিজ্ঞ ব্রেন্ডন টেইলরের সাথে ওয়েসলি মাধভেরের দিকে চেয়ে ছিলো সফরকারী শিবির। কিন্তু টেইলরকে বোল্ড করে বাংলাদেশের জয়ের পথকে মসৃন করেন তাইজুল।

এরপর জিম্বাবুয়ের মিডল-অর্ডারে অনভিজ্ঞ তিন ব্যাটসম্যানকে বড় ইনিংস খেলতে দেয়নি বাংলাদেশের বোলাররা। সর্বোচ্চ ৩৫ রান ওয়েসলি মাধভেরেকে শিকার করেন মিরাজ, সিকান্দার রাজাকে ১৮ রানে বিদায় দেন মুস্তাফিজুর রহমান এবং রিচমন্ড মুতুম্বামি ১৭ রানে রান আউট হন। ফলে ১০৬ রানে সপ্তম উইকেট হারিয়ে ম্যাচ নিশ্চিত করে ফেলে জিম্বাবুয়ে।

শেষ পর্যন্ত ৩৯ দশমিক ১ ওভারে ১৫২ রানে অলআউট হয় জিম্বাবুয়ে। প্রতিপক্ষের শেষ উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ারের ৭শ উইকেট পূর্ণ করেন মাশরাফি। বাংলাদেশের সাইফউদ্দিন ৩টি, মাশরাফি-মিরাজ ২টি করে ও মুস্তাফিজ-তাইজুল ১টি করে উইকেট নেন।

আগামী ৩ মার্চ এই ভেন্যুতেই হবে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে।

স্কোরকার্ড (টস- বাংলাদেশ) :
বাংলাদেশ ব্যাটিং ইনিংস :
লিটন দাস আহত অবসর ১২৬
তামিম ইকবাল এলবিডব্লিউ মাধেভেরে ২৪
নাজমুল শান্ত এলবিডব্লিউ মুতুমবোজি ২৯
মুশফিকুর রহিম ক মুতুমবোজি ব তিরিপানো ১৯
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এলবিডব্লিউ এমপোফু ৩২
মোহাম্মদ মিঠুন এলবিডব্লিউ এমপোফু ৫০
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন অপরাজিত ২৮
মেহেদী হাসান মিরাজ ক কামুনহুকামবে ব মুম্বা ৭
মাশরাফি বিন মুর্তজা অপরাজিত ০
অতিরিক্ত (লে বা-১, ও-৫) ৬
মোট (৫০ ওভার, ৬ উইকেট) ৩২১
উইকেট পতন : ১/৬০ (তামিম), ২/১৪০ (শান্ত), ৩/১৮২ (মুশফিক), ৩/২০৬* (লিটন আহত অবসর), ৪/২৭৪ (মাহমুদুল্লাহ), ৫/২৮৯ (মিঠুন), ৬/২৯৮ (মেহেদি)।
জিম্বাবুয়ে বোলিং :
ক্রিস্টোফার এমপফু : ১০-০-৬৮-২ (ও-১),
চার্ল মুম্বা : ৮-০-৪৫-১ (ও-১),
ওয়েসলি মাধভেরে : ৮-০-৪৮-১,
ডোনাল্ড তিরিপানো : ৭-০-৫৬-১ (ও-৩),
সিকান্দার রাজা : ১০-০-৫৬-০,
তিনোতেন্ডা মুতোমবদজি : ৭-০-৪৭-১।
জিম্বাবুয়ে ব্যাটিং ইনিংস :
তিনাসি কামুনহুকামবে বোল্ড ব সাইফউদ্দিন ১
চামু চিবাবা ক মাহমুদুল্লাহ ব মাশরাফি ১০
রেগিস চাকাবা এলবিডব্লিউ ব সাইফউদ্দিন ১১
ব্রেন্ডন টেলর বোল্ড ব তাইজুল ৮
ওয়েসলি মাধভেরে ক মাশরাফি ব মিরাজ ৩৫
সিকান্দার রাজা ক মাহমুদুল্লাহ ব মুস্তাফিজ ১৮
রিচমন্ড মুতুম্বামি রান আউট (শান্ত/মুশফিক) ১৭
তিনোতেন্ডা মুতোমবদজি ক সাইফউদ্দিন ব মাশরাফি ২৪
ডোনাল্ড তিরিপানো ক এন্ড ব মিরাজ ২
চার্ল মুম্বা বোল্ড ব সাইফউদ্দিন ১৩
ক্রিস্টোফার এমপফু অপরাজিত ৯
অতিরিক্ত (লে বা-১, ও-৩) ৪
মোট (অলআউট, ৩৯.১ ওভার) ৩২১
উইকেট পতন : ১/১ (কামুনহুকামবে), ২/২৩ (চাকাবা), ৩/২৩ (চিবাবা), ৪/৪৪ (টেইলর), ৫/৭৯ (রাজা), ৬/৮৪ (মাধভেরে), ৭/১০৬ (মুতুম্বামি), ৮/১০৯ (তিরিপানো), ৯/১৩০ (মুম্বা), ১০/১৫২ (মুতোমবদজি)।
বাংলাদেশ বোলিং :
মুস্তাফিজুর রহমান : ৬-০-২২-১,
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন : ৭-০-২২-৩ (ও-২),
মাশরাফি বিন মর্তুজা : ৬.১-০-৩৫-২,
তাইজুল ইসলাম : ৯-২-২৭-১ (ও-১),
মেহেদি হাসান মিরাজ : ৮-১-৩৩-২,
মাহমুদুল্লাহ : ৩-০-১২-১।
ফল : বাংলাদেশ ১৬৯ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : লিটন দাস(বাংলাদেশ)।
সিরিজ : তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। সূত্র:বাসস।