স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ

|| মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জহিরুল হক বেলাল ||

[মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জহিরুল হক বেলাল। গ্রামের বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার রানাগাছা ইউনিয়নের গোড়ারকান্দা গ্রামে। তিনি সেনাবাহিনীর একজন অবসর প্রাপ্ত সার্জেন্ট। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের আওতায় সন্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে অবদান রাখেন। ‘স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ শিরোনামে লেখাটি মূলত লেখকের আত্মস্মৃতিমূলক যুদ্ধকালীন সেই স্মৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নানা চিন্তাভাবনার মত প্রকাশ করেছেন তার এই লেখায়। বাংলারচিঠিডটকমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে তার এই লেখাটি।]

দীর্ঘদিন ধরে ভাবছি, মৃত্যুর আগে আমার মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী লিখে যাওয়া উচিৎ। তা না হলে আমার মৃত্যুর পর আমার পরবর্তী প্রজন্মের কেউই আমার যুদ্ধের কাহিনী কিছুই বলতে পারবে না। কেননা আমি আজ পর্যন্ত কারও কাছে এ ব্যাপারে কোন কিছুই প্রকাশ করি নাই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমি যখন আমার যুদ্ধের কাহিনী লিখার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছি তখন আমি নিজ হাতে লিখতে পারি না। কয়েক বছর যাবৎ কলম নিয়ে লিখতে গেলে আমার হাত প্রচণ্ড কাঁপে। আর বর্তমানে আমার স্মৃতিশক্তিও কিছুটা লোপ পেয়েছে। স্মৃতির অনেক পাতা ধূসর হয়ে গেছে। অনেক আগেইতো বার্ধক্যে পৌঁছেছি। এখন শুধুই মৃত্যুর অপেক্ষা। আর কতক্ষণই বা বেঁচে থাকব তা আল্লাহই জানেন।

হারিয়ে ফেলা স্মৃতির মধ্যেও যতটুকু এখনো মনে আছে এবং যা আমার সামনে ঘটেছে ঠিক ততটুকুই লিখছি। কল্পনা থেকে কোন কিছু লিখছি না। আমি কোন লেখক নই, সাহিত্যিক নই। ভুলত্রুটি অনেক কিছুই থাকতে পারে।

সরকার মাঝে মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকা যাচাইয়ের ঘোষণা দেন। যা একটি মহৎ উদ্যোগ। কিন্তু মনে হয়, এতে ভুয়াগুলো বাদ পড়ছে না। বরং ঘুষের বিনিময়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আরও নতুন কিছু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সংযুক্ত হচ্ছে। শুধু এ পর্যন্ত সীমিত থাকলেও বিষয়টি বেদনাদায়ক হতো না। দেখা যায়, এ সময় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অনেকটাই হয়রানির শিকার হয়ে থাকে, নাজেহাল হয়ে থাকেন। নেতাদের সেলামির কষাঘাতে আহত হতে থাকেন।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকা যাচাইয়ের জন্য মাঠ পর্যায়ে যেসব নেতৃবৃন্দকে পদাধিকার বলে নিযুক্ত করা হয় তাদেরই মধ্যেই অনেক সময় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকে। কাজেই সরকার যতই চেষ্টা করুক, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করা একটা সুকঠিন ব্যাপার। সেই যাচাই পর্ব যখন শুরু হয় তখন নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগে। নিজের মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি যুদ্ধ করে আমরা অপরাধ করেছি। কেন এভাবে হয়রানির স্বীকার হচ্ছি? শুধু তা-ই নয়, যাচাই কালে অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনা ও উপহাসের সম্মুখীনও হতে হয়। আমিও সরকারের সাথে একমত হয়ে বলতে চাই, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভূক্ত হোক এবং ভুয়ারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়ুক।

বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেই মুক্তিযোদ্ধের চেতনায় মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীর নিকট সম্মানিত করেছেন। তার পূর্বে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেও লজ্জা বোধ করত। তখন ক্ষমতার ভাগ নিয়ে ছিল আলবদর ও রাজাকাররা। যারা আমাদেরকে মনে প্রাণে ঘৃণা করত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা বহু সংগ্রাম করে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জাতীর নিকট উঁচু করে তুলে ধরেছেন। আমি মনে করি, তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর অসীম কৃপা। সর্বশেষে আমি আল্লাহর দরবারে এ দোয়া করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি যেন দীর্ঘায়ু দান করেন। তিনি যেন আরও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে আমাদের দেশকে ও জাতীকে উন্নতির শীর্ষস্থানে নিয়ে সোনার বাংলা গড়তে পারেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারেন।

আমি পাকিস্তান আমলে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সনে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সাধারণ সৈনিক পদে ভর্তি হই। ছয় মাস ট্রেনিং শেষে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে ব্যাটালিয়ানে জয়দেবপুরে বদলি হই। সেখানে আমাকে আলফা কোম্পানির ১ নম্বর প্লাটুনে বদলি করা হয়। তখন আমার ব্যাটেলিয়ান অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্ণেল (বাঙালি) মাসুদুল হাসান খান। এবং আমার কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন (পাকিস্থানী) মেজর কাজিম কামাল খান। কোম্পানি কর্মকর্তা ছিলেন (ক্যাপ্টেন) জেনারেল এ এস এম নাসিম। তিনি ব্যাটেলিয়ান এ্যাডজুটেন্ট পদেও নিয়োজিত ছিলেন। আরেক জন কর্মকর্তা ছিলেন জেনারেল (সেকেন্ড ল্যাফটেন্যান্ট) (বাঙালি) গোলাম হেলাল মুরশেদ খান। তখন ব্যাটেলিয়ান উপ-অধিনায়ক ছিলেন (মেজর) জেনারেল জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে তিনি চট্রগ্রাম বদলী হয়ে গেলে (মেজর) জেনারেল কে. এম. শফিউল্লাহ উপ-অধিনায়ক পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন তিনি ছিলেন ৩ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক। আমি এ সেক্টরের অধীনেই যুদ্ধ করি। ব্যাটালিয়ানে পৌঁছার ৪/৫ মাস পরে আমাকে এ কোম্পানির ক্লার্কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত আমি কোম্পানির ক্লার্কের দায়িত্ব পালন করি।

জয়দেবপুরের গণ বিক্ষোভ
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা গড়ে উঠে ১৯৭০ এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। সেই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাক ভোটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হন। কিন্তু পাক সামরিক সরকার তার নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতির মনোভাব প্রকাশ করে। তারা চেয়েছিল ভুট্টোকে ক্ষমতায় বসাতে। এ নিয়ে তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ জেগে উঠে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর গোটাদেশের আপামর জনগণ বিদ্রাহী হয়ে উঠে। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে বাঙ্গালী সৈনিকদের ছিল সুসম্পর্ক। কেননা আমরা সবাই বাঙালি।

পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখা শুরু করে। ১৯ মার্চ ১৯৭১ দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে পাক সামরিক জান্তা সুপরিকল্পিত নীল নকশা তৈরি করে। ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের সাথে প্রায় ৬০/৭০ জন পাকিস্তানি সেনা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে জয়দেবপুরে আসে। সেকেন্ড বেঙ্গল কী অবস্থায় আছে তা পরিদর্শনের জন্য। কিন্তু তাদের বাস্তব লক্ষ্য ছিল সেকেন্ড বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা। জয়দেবপুরের জনগণ এ সংবাদ জানতে পেরে গণমিছিলের ডাক দেয়। অল্প সমেয়র ভিতর জয়দেবপুর রেল ক্রসিং থেকে শুরু করে চৌরাস্তা পর্যন্ত হাজার হাজার লোক সমবেত হলো। ওইদিন আবার আমাদের কোম্পানির রেশন আনার জন্য আমরা ৪/৫ জন সৈনিক একটি গাড়িতে করে টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমি নিজেও সেই গাড়িতে ছিলাম। চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছলে জনগণ আমাদের বিস্তারিত ঘটনা জানাল। বলল, আপনারা জয়দেবপুর পৌঁছতে পরবেন না। আপনারা টাঙ্গাইল ফিরে যান। আপনাদের রেশন এবং ফ্রেশের ব্যবস্থা আওয়ামী লীগের নেতারা করে দিবে। পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য একজন বাদে আমরা বাকি সেনারা শার্ট লুঙ্গি পরে জনগণের সাথে মিশে যাই।

সেদিন চৌরাস্তা থেকে জয়দেবপুর বাজার পর্যন্ত ছিল জনতার ঢল। যাতে দ্বিতীয় বেঙ্গল থেকে পাকিস্তানিরা অস্ত্র নিয়ে যেতে না পারে। তারা জয়দেবপুর স্টেশন থেকে দুটি রেলে বগি এনে রাজবাড়ি রেল ক্রসিংয়ের উপর রেখে দিল। যাতে কোন পাক সেনা দল জয়দেবপুর থেকে ঢাকায় যেতে না পারে বা ঢাকা থেকে জয়দেপুর প্রবেশ করতে না পারে। অপর দিকে দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকরা পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। তারাও কিছুটা উগ্রভাবে ছিল। ব্রিগেড অধিনায়ক এসে যখন দেখলো পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপের দিকে তখন তারা অস্ত্র নেওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিল। গণ বিক্ষোভ দেখে ব্রিগেড অধিনায়ক প্রথম গাড়িতে দ্বিতীয় বেঙ্গলের বাঙালি সেনাদের এবং পিছনে দ্বিতীয় গাড়িতে পাক সৈনিকদের নিয়ে জয়দেবপুর থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রেল ক্রসিংয়ে এসে বাধার সম্মুখীন হয় ।

বিদ্রোহী জনগণ পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখলো দ্বিতীয় বেঙ্গলের বাঙালি সৈনিকগণ প্রথম গাড়িতে আছে তখন তারা এক কঠিন পরীক্ষায় পড়ে যায়। এদিকে ব্রিগেড অধিনায়ক দ্বিতীয় বেঙ্গল অধিনায়ককে আদেশ করল ফায়ার করার জন্য। কিন্তু আমাদের লোকেরা তখন সাইডে কচুরি পানাতে এবং গাছের আগায় ফায়ার করে। এ দেখে ব্রিগেড অধিনায়ক গর্জে উঠে বললেন, “তোমার লোকেরা কী গুলি করছে? এখন পর্যন্ত ১০/১২টা লাশ ফেলতে পারল না! হাজার হাজার জনতার সামনে গুলি করলে লাশ পড়ে না এ কেমন কথা? ওদেরকে বল, সরাসরি মানুষের উপর গুলি করতে।”

কিন্তু আমাদের বাঙ্গালী অফিসার ব্রিগেড কমান্ডারকে বুঝিয়ে দিল নিরস্ত্র মানুষের উপর আমরা গুলি করতে পারি না। অপর দিকে জনতার ভিড়ের মধ্য থেকে দেশি অস্ত্র ও দুটি চাইনিজ রাইফেল দ্বারা পাকিস্তানীদের লক্ষ্য করে গুলি করে। এ দেখে ব্রিগেডিয়ার আরও রাগান্বিত হয়ে যায়। তখন পাকিস্তানীরা জনগণের উপর গোলা বর্ষণ করে এবং ১৪৪ ধারা জারি করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে জনগণ এদিক সেদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পাকিস্তানী সৈনিকদের গুলিতে ২ জন বাঙালি মৃত্যু হয়। আমরাও চলে এসে আমাদের গাড়িতে আরোহণ করি এবং রেশন না নিয়েই চলে আসি। এভাবে জনতার ভিড় কমতে থাকে। পরে রেল ক্রসিং থেকে রেলগাড়ির বগিও সরিয়ে ফেলা হয়। ব্রিগেড অধিনায়কও বুঝতে পারে, যে বাঙালি জনতার পাশাপাশি বাঙালি সৈনিকরাও পাকিস্তানীদের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। তখন দ্বিতীয় বেঙ্গল অধিনায়ক লে. কর্ণেল মাসুদুল হাসান খানকে আদেশ দিয়ে বললেন, যে কোন উপয়ে হোক আমাদের ঢাকা ক্যান্টেনমেন্টে পৌঁছার ব্যাবস্থা করে দেও। যাবার সময় ব্রিগেড অধিনায়ক লে. কর্ণেল মাসুদুল হাসানকে ঢাকায় চলে আসতে হুকুম দিয়ে যান। ২১ মার্চ লে. কর্ণেল মাসুদুল হাসান ঢাকায় চলে যান। তার স্থলে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট থেকে (বাঙালি) লে. কর্ণেল রাকিবকে সেকেন্ড বেঙ্গলের অধিনায়কের দায়িত্বে পাঠায়। ভিতরের এ সকল কথাবার্তা ও ঘটনা পরে আমার সাথী সৈনিক ভাইদের থেকে শোনেছি।

এর পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাগণ সেকেন্ড বেঙ্গলকে সর্বদিক দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করত। যেভাবে এদেশের সাধারণ মানুষের মনে আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ছিল ঠিক সেভাবেই আমরা যারা বাঙ্গালী সৈনিক ছিলাম তাদের মনেও আন্দোলন সাড়া দিয়ে ছিল। পার্থক্য ছিল আন্দোলনের প্রারম্ভিক পর্বে ও প্রস্ততি পর্বে আমরা প্রকাশ্যে আন্দেলনের মাঠে নামি নাই। আমরা সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। ১৯৭১ সালে মার্চের প্রথম থেকেই আমরা সিগন্যাল প্লাটুনের গোপন কোড নম্বরের মাধ্যমে আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতাম ও সংবাদ আদান প্রদান করতাম।

১৯৭১ সালে আই এস ডিউটির জন্য আমাদের আলফা কোম্পানিকে টাঙ্গাইলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন আমার কোম্পানি অধিনায়খ ছিলেন মেজর কাজিম কামাল খান এবং (ক্যাপ্টিন) জেনারেল এ এস এম নাসিম সাহেব তখন আমার কোম্পানির কর্মকর্তা এবং ব্যাটালিয়ান এ্যাডজুন্টেন্ট পদে নিযুক্ত ছিলেন। টাঙ্গাইলে আসার পর যখন গোটা দেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করে তখন সম্ভবত ২০ মার্চ আমরা (ক্যাপ্টিন) জেনারেল নাসিম সাহেবের সাথে পরামর্শ করলাম। “দেশের এ পরিস্থিেিত আমাদের করণীয় কী?” নাসিম সাহেব আমাদের বললেন, “তোমরা একটু ধৈর্য ধর। আমরা যারা বাঙ্গালী অফিসাররা আছি সকলের সম্মতিতে একত্রে একসাথে পাক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে।”

২৫ মার্চ রাতে আমাদের সেই সুযোগ এসে যায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভিতর যতগুলো বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল সবগুলোই একত্রে বিদ্রোহ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। (ক্যাপ্টিন) জেনারেল নাসিম সাহেব আমাদেরকে অস্ত্রাগার থেকে নিজ নিজ গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে বললেন। আমি অস্ত্রাগার থেকে চায়না ৭.৬২ এম এম এল এম জি এবং ১২ বাক্স এল এম জির গুলি নিয়ে নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এল এমজির মাধ্যমেই আমি যুদ্ধ করেছি। আমাদের সঙ্গে যে সকল পাঞ্জাবী, পাঠান ও বিহারী সৈনিক ছিল তাদের কাছ থেকে পূর্বেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা নিয়ে নেওয়া হয়।

ওই রাত্রেই আনুমানিক ১২টার দিকে মেজর কাজিম কামাল খান সহ যতগুলো পাঞ্জাবী, পাঠান ও বিহারী কর্মকর্তা ও সৈনিক ছিল তাদের সবাইকে হত্যা করা হল। ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব আমাদেরকে গাড়িতে আরোহণ করতে বললেন। অতিদ্রুত আমাদের কোম্পানির যাবতীয় সামানা ও রেশনসহ গাড়ি লোড করা হলো। সম্ভবত রাত ২টার দিকে আমরা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কেননা, তখন আমরা শুনেছিলাম, ময়মনসিংহ বিডিয়ার ক্যাম্পে বাঙ্গালী ও পাকিস্তানীদের সহিত গোলাগুলি চলছিল। তাই বাঙ্গালী বিডিয়ারদের সাহয্যার্থে আমরা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সকালে আমরা মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য নাস্তা করার উদ্দেশ্যে বিশ্রাম নেই। ওই সময় (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেব আমাকে বললেন, “তোমার বাড়ি নাকি এখান থেক খুব নিকটে, তুমি বাড়িতে গিয়ে তোমার আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাত করে ময়মনসিংহে এসে আমাদের সাথে যোগ দিবে।” জবাবে আমি বললাম, “স্যার, আমার পক্ষে বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, বিশেষ করে আমার নানি আমাকে যুদ্ধের ময়দানে না-ও আসতে দিতে পারে। তাই আমি যেতে চাচ্ছি না।”

আমাদের নাস্তা পর্ব শেষ হওয়ার পরপরই আমরা সংবাদ পাই বিডিআরদের সহিত পাক বাহিনীর গোলাগুলি বন্ধ হয়েছে এবং সমস্ত বাঙালি বিডিআররা আমাদের সহিত যোগ দিতে চাচ্ছে। আমরা এ সংবাদ শোনার পর পুনরায় ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ময়মনসিংহে পৌঁছে আমাদের কোম্পানিকে ময়মনসিংহ সার্কিট হাইজ ও ডাক বাংলাসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে বলা হয়।

আমার কোম্পানির এস জেসিও ছিল সুবেদার নূরল আজিম চৌধুরি এবং প্লাটুন অধিনায়ক ছিল সুবেদার মনির আহমেদ এবং প্লাটুন সহ অধিনায়কের দায়িত্বে ছিল নায়েব সুবেদার জনাব আলী। আমরা ময়মনসিংহে দু’দিন থাকার পর পাকিস্তানী জঙ্গি বিমান আমাদের ক্যাম্পের উপর দিয়ে চক্কর দিতে থকে। আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের অবস্থান সম্পর্কে তাদেরকে সংবাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা ওইদিন ট্রেন যোগে ভৈরবের দিকে রওনা হই। ওই সময় রাস্তার দু’পাশ থেকে হাজার হাজার জনতা আমাদেরকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানায়। এবং বিভিন্ন রকম ফলমূল খাদ্য, সিগারেট, ম্যাচ ইত্যাদি আমাদের ট্রেনে দিয়ে যায়। সকলেই আমাদের জয়যুক্ত হওয়ার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করছিল। ওই সময় কয়েক জন লোক বাংলাদেশের নতুন পাতাকা আমাদের দিয়েছিল। আমি একজনের থেকে একটি পতাকা আগ্রহভরে চেয়ে নিলাম। পতাকাটির সবুজের মধ্যে লাল বৃত্তের ভিতর হলুদের রং এর বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা ছিল। এ পতাকাটি আমার খুবই পছন্দ হল। সাথে সাথেই তা বুকে বেঁধে নিলাম। আর প্রতিজ্ঞা করলাম, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এ পতাকা আমার বুকেই রাখব। আমার দেখা দেখি অনেক সৈনিক ভায়েরাই তাদের পতাকা বুকে বেঁধে ফেলল। পরবর্তীতে আবার অনেকেই তা খুলে ফেলেছিল। কিন্তু আমি খুলিনি। ১৬ ডিসেম্বর ৭১ পর্যন্ত তা আমার বুকেই ছিল। আমার কমান্ডার পতাকা বুকে বেঁধে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। কেননা, দূর থেকে দেখে শত্রুরা পতাকা লক্ষ্য করে গুলি করবে। তাই পতাকা বুকে বেঁধে উপরে শার্ট পরতাম। ইচ্ছা ছিল, যুদ্ধে মারা গেলে দেশের পতাকা বুকে নিয়েই যেন মরতে পারি।

সেখানে পৌঁছে নাসিম সাহেব আমাদেরকে একটি স্কুল বিল্ডিংয়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন। ওইদিন পাকিস্তান থেকে হঠাৎ করে ক্যাপ্টেন সেলিম সাহেব আমাদের মাঝে উপস্থিত হন। তিনি ইতিপূর্বে আমাদের ব্যাটালিয়ানের এডজুটেন্ট পদে দায়িত্বে ছিলেন। পরে উনাকে পাকিস্তানে বদলি করা হয়। জেনারেল নাসিম সাহেব ও আমরা ক্যাপ্টেন সেলিম সাহেবকে কাছে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। তার কিছুক্ষণপর দেখা গেল পাকিস্তানী একটি জঙ্গি বিমান ভৈরব শহরের উপর দিয়ে চক্কর চালায়। জঙ্গি বিমানটি চলে যাওয়ার পরপরই আমরা ভৈরব থেকে আশুগঞ্জ চলে যাই।… চলবে

স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ । পর্ব-২