শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্তীকরণের দাবি

অভিভাবকদের সাথে বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন সংসদ সদস্য মির্জা আজম । ছবি : বাংলারচিঠি ডটকম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, জামালপুর
বাংলারচিঠি ডটকম

১৮ বছর পর ২০১৭ সালে সরকারি সিদ্ধান্তে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় বাংলাদেশ কৃষিবিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজটিকে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বিলে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজটিকে আত্তীকরণের কোনো উল্লেখ না থাকায় কলেজটির কি হবে, এ নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। কলেজটির সকল শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং চার শতাধিক শিক্ষার্থীরা পড়েছেন বিপাকে। শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে দফায় দফায় আন্দোলন করে শিক্ষাবর্ষ থেকে পিছিয়ে পড়ায় এ নিয়ে অভিভাবকরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জামালপুর, নেত্রকোণা, শেরপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা এই পাঁচটি জেলার সমন্বয়ে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে জামালপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নিং বডির সভাপতি তৎকালীন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক আবুল কালাম শামসুদ্দিন স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয়, ‘জামালপুর জেলায় প্রতিষ্ঠিত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজের স্থলে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর করার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদন নিতে হবে মর্মে প্রধানমন্ত্রী অনুশাসন প্রদান করেছেন।’

এর প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদন নিয়ে পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে একই বছরের ২৫ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আরেক স্মারকপত্রে বলা হয়, ‘জামালপুর জেলায় প্রতিষ্ঠিত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্থাপনের নীতিগত সদয় সম্মতি প্রদান করেন।’ নিয়ম অনুযায়ী এই পত্রের অনুলিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে পাঠান তারা।

ক্যাম্পাসে অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। ছবি : বাংলারচিঠি ডটকম

এর তিনমাস পর ২৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক পত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির ওই নামের অনুমোদন দেয় ট্রাস্ট। পরবর্তীতে সকল প্রক্রিয়া শেষে মির্জা আজমের প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কলেজটিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করে দেশের ৩৯তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০১৭’ পাস হয়।

পরবর্তীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ায় ফিশারিজ কলেজের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মাঝে আশার সঞ্চার হয়। শিক্ষার্থীরা দ্রুত সময়ের মধ্যে উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে কলেজটিকে আত্তীকরণের দাবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে দফায় দফায় আন্দোলন করেন। একপর্যায়ে গত বছরের ২১ জুন প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও আণবিক জীববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নিরঞ্জন কুমার সানা। তিনি যোগদানে অপরাগতা দেখালে শিক্ষার্থীরা ফের একই আন্দোলনের ডাক দেন। একই বছরের ১৪ নভেম্বর নতুন উপাচার্য নিয়োগ পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শামসুদ্দিন আহমেদ। নতুন উপাচার্য যোগদান করার পর শিক্ষার্থীরা তার কাছেও আবেদন জানান। কিন্তু ফিশারিজ কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আত্তীকরণের আইন বা নির্বাহী আদেশ না থাকার কথা জানিয়ে দিলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে নতুন করে ফের হতাশা ও দু:শ্চিন্তা দেখা দেয়।

ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমবেত অভিভাবক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ। ছবি : বাংলারচিঠি ডটকম

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের শুরু থেকে কলেজ আত্তীকরণ আন্দোলনের কারণে লেভেল-১ এর প্রথম সেমিস্টার এবং লেভেল-২ এর প্রথম সেমিস্টারের মোট ১৭৮ জন শিক্ষার্থী বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা দেয়নি। ফলে তারা পিছিয়ে পড়েছে। তাদেরকে এখন পুনরায় নতুন করে ভর্তি হতে হবে। কলেজ কর্তৃপক্ষ অনেক দেনদরবার করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লেভেল-১ এর প্রথম সেমিস্টারের ১০০ জন শিক্ষার্থীর পুনরায় ভর্তির অনুমোদন পেয়েছেন। ২৭ জানুয়ারির মধ্যে তারা ভর্তি না হলে শিক্ষাজীবন থেকে তারা ছিটকে পড়বেন। একই বছরের লেভেল-২ এর প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের পুনরায় ভর্তির অনুমোদন না পাওয়ায় তারাও রয়েছে দু:শ্চিন্তায়। তাদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে লেভেল-৩ ও লেভেল-৪ এর দুই শতাধিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশের শিক্ষাজীবনের একই অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। একই সাথে সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির তিনটি অনুষদের চারটি বিভাগে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে।

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নিং বডির সভাপতি বর্তমান সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ২১ জানুয়ারি সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিদর্শনের কথা জানতে পেরে ফিশারিজ কলেজের সকল শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাকরাও সেখানে সমবেত হন। বেলা ১২টার দিকে সংসদ সদস্য মির্জা আজম ক্যাম্পাসে গেলে প্রশাসনিক ভবনের সভাকক্ষে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সাথে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয় তুলে সংসদ সদস্য মির্জা আজমের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং কলেজটিকে আত্তীকরণ করে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানান।

এ সময় মির্জা আজম অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ থেকে পিছিয়ে পড়ার জন্য আপনারাই দায়ী। তারা পরীক্ষা বর্জন করে কেন। এর দায়ভার কে নিবে। আপনাদের ছেলেমেয়েরা তো ফিশারিজ কলেজে ভর্তি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া থেকে জাতীয় সংসদে বিল পাশ হওয়া পর্যন্ত যেকোনো কারণেই হোক একটু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তখন আমাদের বিষয়টি নজরে আসেনি।’ তিনি শিক্ষার্থীদের বিদ্যমান অবস্থায় নিয়মিত ক্লাস করা এবং সকল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই কলেজটি আমি প্রতিষ্ঠা করেছি। এটি এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আত্তীকরণের বিষয়ে, হয়তো একটু সময় লাগবে। সবাইকে ধৈর্য্য ধরতে হবে।’

বৈঠক শেষে সংসদ সদস্য মির্জা আজম চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মাঠে সমাবেশ করেন। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর থেকে আসা অভিভাবক আল মামুন মহসীন বাংলারচিঠি ডটকমকে বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের প্রেক্ষিতেই আমার মেধাবী মেয়েকে এখানে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি কলেজ আত্তীকরণ নিয়ে জটিলতা চলছে। আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবন নিয়ে খুবই দু:শ্চিন্তায় আছি। কলেজটির সভাপতি সংসদ সদস্য মির্জা আজমের কাছে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাথে আত্তীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছি।’

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. রফিকুল বারী বাংলারচিঠি ডটকমকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনুমোদনের সকল প্রক্রিয়ায় সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও কলেজটির ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে আইনি জটিলতা দেখা দিয়েছে। এর সমাধান পেতে হয়তো একটু সময় লাগবে। এটা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ শামসুদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বাংলারচিঠি ডটকমকে বলেন, ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০১৭’ আইনে ফিশারিজ কলেজটির বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। আমি এখানে যোগদান করেই সমস্যাটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করি। আইনে উল্লেখ না থাকার কথা জানিয়ে তারা আমাকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাওয়ার কথাই বলেছেন। তবে কলেজ কর্তৃপক্ষ কেন যে শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময় কমিটমেন্ট করেছিলেন এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আত্তীকরণ হয়ে যাবে। এটা তারা ভুল করেছেন। তবে আমি চাইবো একীভূত হোক।

তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় সেখানকার দুটি কলেজকে পরবর্তীতে আত্তীকরণ করা হয়েছিল বলে উদাহরণ টেনে বলেন, রাজশাহীতে অবশ্য শিক্ষার্থীরা কলেজের আওতায় সনদ পেয়েছে। পরবর্তীতে অনুষদ খুলে কলেজ দুটি বিলুপ্ত করা হয়। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজের ক্ষেত্রে সামনে কি সিদ্ধান্ত আসবে এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে কলেজ প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নিং বডির সভাপতি সাবেক প্রতিমন্ত্রী সংসদ সদস্য মির্জা আজমও চান কলেজটি আত্তীকরণ হোক। উনার সাথে এ নিয়ে আমার কথা হয়েছে। উনি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।