জামালপুরের বকশীগঞ্জে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ও জিঞ্জিরাম নদীর ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদী পাড়ের মানুষ। এতে করে উপজেলার সাধুরপাড়া ও মেরুরচর ইউনিয়নের পাঁচ গ্রামের বসত ভিটাসহ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভাঙন কবলিতরা সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছে। ভাঙন রোধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে কুতুবের চর, বাংগালপাড়া গ্রাম।
নদী ভাঙন ঠেকাতে সরকারি কোন পদক্ষেপ না থাকায় চরম দুর্ভোগে রয়েছেন নদী পাড়ের মানুষ। ভাঙনের শিকার নদীপাড়ের মানুষের আত্মচিৎকার ও আর্তনাদ যেন শুনছেনই না প্রশাসন৷

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়নের বাংগাল পাড়, কুতুবের চর ও মেরুরচর ইউনিয়নের উজান কলকিহারা, ফকিরপাড়া ও বাঘাডোবা গ্রামে ব্যাপক নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের শব্দে ঘুম হারাম হয়ে গেছে এসব গ্রামের মানুষের। গত এক মাসের ভাঙনে অনেক পরিবারই এখন নি:স্ব। ভাঙন রোধে ব্যবস্থা না নেয়ায় চরম হতাশায় ভুগছেন ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ। প্রকৃতির নির্মমতায় চোখের জলে ভাসছে ভাঙন কবলিতরা।
নদী ভাঙনে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের বাঙ্গালপাড়া, কুতুবেরচর ও মেরুরচর ইউনিয়নের উজান কলকিহারা, বাঘাডোবা ও ফকির পাড়া গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবারের বসতভিটা নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। নদী ভাঙনে বিলীন হয়েছে কয়েকশ’ বিঘা ফসলি জমি ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইতোমধ্যে বাংগালপাড়া ও কুতুবেরচর গ্রামের জিন্নাহ মিয়া, জুব্বার আলী, মিস্টার আলী, মিল্লাত মিয়া, ফজল মিয়া, মানিক আলী, ইয়ার হোসেন, শহিজল হক, আব্দুল হামিদ, লুৎফর রহমানসহ প্রায় ৩০ জনের ৫০টি বাড়িঘর ও একটি গ্রামীণ রাস্তাসহ কয়েকটি বিদ্যুতিক খুঁটি নদীতে ভেঙে গেছে। ফলে এ দুই গ্রামে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বিলীনের অপেক্ষায় রয়েছে কুতুবের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে বাংগালপাড়া, কুতুবের চর, বাঘাডোবা, উজান কলকিহাড়া, ফকির পাড়া এলাকার আরও শতাধিক বাড়ি ঘর ও শত শত বিঘা ফসলি জমি।
নদী ভাঙনের ফলে বসতভিটা, ফসলি জমি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে পরিবারগুলোর। নদী ভাঙন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ না থাকার কারণে ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ দুর্দশায় পড়লেও এখন পর্যন্ত কেউ খোঁজ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
এসব পরিবার বার বার নদী ভাঙনের শিকার হওয়ায় আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছেন। এ কারণে সামাজিক মর্যাদাও হারিয়েছেন তারা। স্থানীয়দের দাবি ভাঙন রোধে ব্যবস্থা না নিলে অস্তিত্ব হারাতে পারে পাঁচটি গ্রাম। তাই অবিলম্বে বাঁধ নির্মাণ ও ডাম্পিং ফেলে এই গ্রামগুলোকে ভাঙন থেকে রক্ষার দাবি জানান এলাকাবাসী।
ভাঙন কবলিত বাংগালপাড়া গ্রামের আব্দুস সাত্তার বলেন, এসব চর এলাকাবাসীর পাশে কেউ নেই। নির্বাচন এলে অনেক নেতা-কর্মীদের আনাগোনা দেখা যায়। ভোটের বিনিময়ে অনেক কিছুই দিতে চায়। ব্রিজ করে দিবে বাঁধ করে দিবে ইত্যাদি। নানান ওয়াদা দেয়। কিন্তু নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে সেসব কাজ তো দূরের কথা নেতা-কর্মীদের খুঁজে পাওয়া যায় না।

কৃষক লুৎফর রহমান বলেন, নদীতে পানি কম কিন্তু নদী ভাঙ্গন ব্যাপক। দুটি ঘর সরিয়েছি আরেকটা সরাচ্ছি। গরু, বাছুর, স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বিপাকে আছি, ভিটাবাড়ি তো সব নদীতে চলে গেল। থাকবো কোথায়? প্রশাসনের কোন লোক খোঁজ খবর নিচ্ছে না। এমনকি নদী ভাঙন ঠেকাতে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সাজেদা বেগম বলেন, এইবার নিয়ে চারবার ঘর সরিয়ে নিলাম আর কত। টাকা পয়সাও নেই। এখন আমরা নি:স্ব।
প্রতিবন্ধী আব্দুল জুব্বার বলেন, নদীর ভাঙনে আমরা নি:স্ব হয়ে যাচ্ছি। বারবার ভাঙনের ফলে মানচিত্র বদলে যাচ্ছে এই এলাকার। আমরা ভিটামাটি ও ফসলি জমি হারিয়ে বিপদের মধ্যে রয়েছি। তাই ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
সুশাসনের জন্য নাগিরিক-সুজন এর বকশীগঞ্জ উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জিএম ফাতিউল হাফিজ বাবু বলেন, প্রতি বছর শুকনো মওসুমে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নদীতে বালু উত্তোলন করা হয়। ফলে বন্যা শুরু হলে নদ ও নদীর ভাঙন তীব্র হয় এবং মেরুরচর, সাধুরপাড়া ও নিলাখিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে নদী ভাঙন দেখা দেয়। শুকনো মওসুমে যদি ডাম্পিং বা নদী ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ করা যায় তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা কমে আসবে। ভাঙন কবলিতদের রক্ষা করতে হলে পরিকল্পনামাফিক ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই।
মেরুরচর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম মনজু জানান, অনেক প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হুমকির মুখে রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে শিগগিরই ডাম্পিং করা না হলে এই পাঁচ গ্রামের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। তাই আমরা জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা এ প্রতিবেদককে বলেন, সাধুরপাড়া ও মেরুরচর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। তা আমরা অবগত হয়েছি। যেসব পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে তাদেরকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। ভাঙন ঠেকাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।