প্যারেট পোকায় বিশ্বমানের পোল্ট্রি খাদ্য তৈরি করছে শেরপুরের শফিক

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর, বাংলারচিঠিডটকম: বিশ্বমানের ও স্বল্পমূল্যে পুষ্টিকর প্রাকৃতিক পোল্ট্রি খাদ্য ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই বা প্যারেট পোকা এখন শেরপুরের নকলায় উৎপাদন হচ্ছে। জেলায় প্রথমবারের মত ওই পোকা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার স্বপ্ন দেখছেন শফিকুর রহমান শফিক নামে এক উদ্যোক্তা। এদিকে প্যারেট পোকা চাষে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ ও ভেটেনারী কর্মকর্তারা।

শফিকের বাড়ি উপজেলার নারায়নখোলার চরবসন্তী গ্রামে। সে ওই গ্রামের সোরাতুজ্জামানের ছেলে।

উদ্যোক্তা শফিকুর রহমান শফিক ২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে জানান, ইউটিউবে ভিডিও দেখে তিনি হাঁস, মুরগি ও মাছের প্রাকৃতিক খাবার প্যারেট পোকা চাষ করবেন বলে ভাবতে থাকেন। সেই ভাবনাকে বাস্তবে রুপ দিতে ওই পোকার বীজ সংগ্রহ করতে তিনি ছুটে যান গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জে। ওই এলাকার ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকারের কাছ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকায় প্যারেট পোকার এক কেজি বীজ বা লার্ভা কিনে আনেন।

এক প্রশ্নের জবাবে শফিক জানান, ওইসব পোকার সংখ্যা বাড়াতে শুরু করেন পরিচর্যার কাজ। দৈনন্দিন খাবারের ফেলে দেওয়া অংশ যেমন পাকা কলা, পঁচা আলু, মাছ ও মুরগির নাড়িভুড়ি, গম ও ভূট্টার গুড়াসহ বিভিন্ন ধরনের পচনশীল দ্রব্য দেওয়া হয় পোকাগুলোকে। মাত্র ৪৫ দিনের মধ্যেই খামারে শুরু হয় উৎপাদন। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে লার্ভা ও পোকার সংখ্যা। আর সবচেয়ে বেশী লার্ভা পাওয়া যায় গরমকালে।

শফিক বলেন, একটি পূর্ণ বয়স্ক প্যারেট পোকা পাঁচ হাজার ডিম দেয়। মাত্র দশ গ্রাম ডিম থেকে অন্তত ৩০ কেজি লার্ভা পাওয়া যায়। সেইসব লার্ভা হাঁস, মুরগি ও মাছের জন্য খুবই উন্নত মানের খাবার। বর্তমানে তার খামারে প্যারেট পোকার লার্ভা ও মাতৃপোকা তৈরি হচ্ছে। আর এর উৎপাদন ব্যয় নাই বললেই চলে।

তিনি আরো বলেন, চলতি মাসের ১৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তত্ত্বাবধানে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি প্যারেট পোকা নিয়ে যান। ওই দিন ময়মনসিংহ জেলা থেকে আসা একদল দর্শনার্থী প্যারেট পোকা চাষের আগ্রহ দেখান। সেই সাথে ওই দর্শনার্থীরা তার কাছ থেকে প্যারেট পোকা কিনবেন বলে জানায়।

দেশ ও বিদেশে প্যারেটের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে শফিক বলেন, চাকুরি না খুঁজে বাণিজ্যিকভাবে প্যারেট পোকা চাষ করে হাজারো যুবক-যুবতী তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারেন।

জানতে চাইলে স্থানীয় পোল্ট্রি খামারি তোফাজ্জল মিয়া, আতাহার আলী ও শিহাবউদ্দীন বলেন, সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই বা প্যারেট পোকা। এই পোকা খুবই উচ্চ প্রোটিন যুক্ত ও অন্যান্য ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ। আর শতভাগ প্রাকৃতিক। প্যারেট পোকা রোগ বহন করেনা। উল্টো ই-কোলাই, স্যালমোনেলা ও টক্সিনের মতন ভয়ংকর রোগকে ধ্বংস করে।

এই প্যারেট পোকা উৎপাদন বা পালিত হয় পচনশীল যেকোনো পরিত্যাক্ত বস্তু ও বর্জ্য থেকে। যা পরিবেশ ভালো রাখে ও এ থেকে জৈব সার উৎপাদন করে কৃষি জমিতে ব্যবহার করা যায়।

তারা আরো বলেন, বর্তমানে মৎস্য, পোল্ট্রি ও হাঁস পালনের প্রধান অন্তরায় খাদ্য ব্যয় ও রোগবালাই। খামারের ৮০ ভাগ ব্যয় হচ্ছে খাদ্যের পিছনে। তারপরও কোয়ালিটি সম্পন্ন খাদ্যের ব্যাপক সংকট রয়েছে। এছাড়া পোল্ট্রি খাদ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে বিষাক্ত পরিত্যাক্ত ট্যানারীর বর্জ্য। যা মানবদেহ ও পশু-পাখির জন্যও ক্ষতিকর। এইসব ক্ষতিকর উপাদানে তৈরিকৃত খাদ্য কিনতে হচ্ছে লাগামছাড়া দামে। মূলত এজন্যই লস হচ্ছে খামারিদের।

গুণগত মানের খাদ্যের অভাব, উচ্চমূল্য এবং বিভিন্ন স্পর্শকাতর রোগ বহন করায় ওষুধের পিছনেও বিশাল অংকের ব্যয় হচ্ছে। শুধু তাই না ভ্যাকসিন করেও ঠেকানো সম্ভব হচ্ছেনা রোগবালাই।

তারা মনে করেন জেলায় শফিকের মতো আরও উদ্যোক্তা প্যারেট চাষে এগিয়ে এলে পোল্ট্রি শিল্প নতুন করে প্রাণ শক্তি ফিরে পাবে।

কালো সৈনিক পোকা, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই বা প্যারেট নামক এই পোকা নিয়ে গেল ১১ বছর যাবত গবেষণা করে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম।

তিনি জানান, চায়না, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতে ক্যাটফিস, তেলাপিয়া ও হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবে কালো সৈনিক পোকার লার্ভা ব্যবহার করে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে। আমাদের দেশের জলবায়ু কালো সৈনিক পাকার জন্য উপযোগী হওয়ায় এর ব্যাপক উৎপাদন সম্ভব। ফলে এটি চাষের মাধ্যমে আমরাও কম খরচে মাছ এবং হাঁস-মুরগির ভেজাল মুক্ত খাবার উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন হওয়া সম্ভব।

অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, ময়লা-আবর্জনা, পচনশীল ফলমূল, শাক সবজি, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা এবং গৃহপালিত প্রাণীর মল ভক্ষণ করে পোকাটির লার্ভা। সেই লার্ভা মাছের বিকল্প খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এই পোকা জৈব আবর্জনার ৭১.৫ শতাংশ পর্যন্ত ভক্ষণ করে হজম করে থাকে। অবশিষ্ট অংশ বায়োডিজেল, প্রোটিন এবং কম্পোস্ট সারে রূপান্তরিত হয়।

ওই গবেষক আরও বলেন, কালো সৈনিক পোকা পরিবেশবান্ধব এবং কৃষকের বন্ধু। শুষ্ক অবস্থায় এই পোকার লার্ভা থেকে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আমিষ, ৩০ থেকে ৩৬ শতাংশ স্নেহ এবং ২০ থেকে ২২ শতাংশ শর্করা পাওয়া গেছে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সোডিয়াম এই পোকার লার্ভাতে রয়েছে।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ ও ভেটেনারী কর্মকর্তা ডা. আব্দুর আহাদ বলেন, নকলার খামারী শফিকুর রহমান শফিক অল্প দিনেই প্যারোট পোকা চাষে সফলতা পেয়েছেন। এ অঞ্চলে কেউ ওই পোকা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে চাইলে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া বলে তিনি জানান।