শেরপুরে আদিবাসীদের ছয় দফা না মানলে আন্দোলন আরও জোরদার করার ঘোষণা

মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে আদিবাসী সংগঠনগুলো। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

শেরপুরের শ্রীবরদীর পাহাড়ে বনকর্মীরা গারো কৃষকদের জুমফসল কেটে ধ্বংস করার ঘটনায় ফুঁসে ওঠেছে আদিবাসীরা। জেলার পাঁচ উপজেলার আদিবাসী সংগঠনগুলো ফসলের ক্ষতিপূরণসহ ছয় দফা দাবিতে লাগাতার মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ, সাংবাদিক সম্মেলন এবং বন কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচী পালন করেছে। ইতোমধ্যে ওইসব সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে দাবি সংশ্লিষ্ট স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছে।

আদিবাসী নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, আগামী ৫ অথবা ৬ সেপ্টেম্বর তারা এ বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে বসবেন। যদি তা ফলপ্রসূ না হয় তাহলে অস্তিত্ব রক্ষায় এ আন্দোলন সংগ্রাম আরও জোরদার এবং বেগবান করা হবে। অন্যদিকে বনাঞ্চলে অবৈধভাবে কৃষি পণ্য উৎপাদন করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে বনবিভাগ।

জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া শ্রীবরদী ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা, নালিতাবাড়ীর লুইস নেংমিঞ্জা, ঝিনাইগাতীর নবেশ খকসী ও সদর উপজেলার ডেনিসন দুলাল মারাক স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিতে বলা হয়, জেলার সদরসহ শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও নকলার এই পাঁচ উপজেলায় গারো, কোচ, বর্মন, হাজং, ডালু, হদি ও বানাই জাতিগোষ্ঠী স্মরণাতীতকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। বর্তমানে এদের সংখ্যা ৬৫ হাজার। এইসব জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্রপূর্ণ সংস্কৃতি দেশের সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। তারা শান্তিপ্রিয়, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আদিবাসীরা দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখে জাতীয় স্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বারবার। ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধেও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তাদের।

মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে আদিবাসী সংগঠনগুলো। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

আদিবাসী জনগণ জীবিকার অবলম্বন হিসেবে কৃষিকেই একমাত্র পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এইসব জাতিগোষ্ঠী বন আইন প্রণয়নের অনেক আগে থেকেই বনাঞ্চলে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। বন ও পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হয় এমন কোন কাজে আদিবাসীরা কখনোই লিপ্ত হয়নি।

আদিবাসীদের মাঝে শান্তিপূর্ণ এই পরিবেশকে অশান্ত করতে বনবিভাগ বালিজুড়ি রেঞ্জের অসৎ, লোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আদিবাসী জীবন ধারা দুর্বিষহ ও অশান্ত হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১২ আগস্ট দুপুরে বালিজুড়ি খ্রিস্টানপাড়া গ্রামে বন ভূমি উদ্ধারের নামে চুপিসারে অনুপ্রবেশ করে পাঁচটি দরিদ্র আদিবাসী ও প্রতিবন্ধী পরিবারের দেড় একর জমিতে রোপণ করা সুপারি বাগান, ঝিঙা, বরবটি, বেগুন, শিমুল আলু ও করলার বাগান বিনা নোটিশে কেটে ফেলে বনকর্মীরা।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ আগস্ট অত্রাঞ্চলের ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সহযোগী সংগঠনগুলো ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির আশায় প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে। গণতান্ত্রিক এই প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা ও তাদের সহযোগীরা আদিবাসী পরিবারগুলোকে অব্যাহতভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এতে ভুক্তভোগী পরিবারসহ আদিবাসী জনমনে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক।

তাই শান্তি বিনষ্টকারী বালিজুড়ি রেঞ্জের অসৎ বিট কর্মকর্তা ও রক্ষীদের অপসারণ। ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ আদিবাসী পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান। আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদান। বনবিভাগ কর্তৃক আদিবাসীদের সামাজিকভাবে হয়রানি ও মিথ্যা মামলা বন্ধ। বনবিভাগের উস্কানিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, বক্তব্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অপতৎপরতা বন্ধ। বসতভিটায় বাড়ি নির্মাণ ও সংস্কার কাজে বাধা দেওয়া বন্ধের দাবি তোলা হয়।

জেলা প্রশাসকের কাছে দাবি সংশ্লিষ্ট স্মারকলিপি পেশ করা হয়। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

এছাড়া আদিবাসীদের ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ভূমির সীমানা নির্ধারণ করে স্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ। ভূমি থেকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে বনবিভাগ কর্তৃক প্রনীত তালিকা বাতিল। বসতভিটা ও ভূমিতে কোন উন্নয়ন প্রকল্প নিতে চাইলে আদিবাসীদের পরামর্শ নেয়া এবং সুফল প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা বন্ধ করাও দাবি জানানো হয়।

আদিবাসী নেত্রী মিসেস ঋনিকা দালবত (ঋনি) বলেন, বহু দিন যাবত এ অঞ্চলে বন্য হাতির উপদ্রুপ। এ কারণে এখানে ফসল উৎপাদন করা অনেক কষ্টকর। অন্যদিকে বন বিভাগ আমাদের কৃষি পণ্য উৎপাদনে বাধা দিচ্ছে। আমাদেরকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে দাবি দাওয়া তুলে ধরলে তারা আমাদের পাগল বলে অভিহিত করে।

তিনি আরও বলেন, শতশত বছর আমরা বনে বাস করছি। এখানে উৎপাদিত সবজি বাজারে বিক্রি করে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা এবং জীবিকা নির্বাহ হয়। এখন বনবিভাগের কর্মকর্তারা আমাদের বাড়ির আঙ্গিনার ফসল কেটে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এত কষ্টের ফসল নষ্ট করে দেওয়ায় ভরণপোষণের সকল পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

নালিতাবাড়ীর নারী নেত্রী মিসেস কেয়া নকরেক বলেন, বন বিভাগের দাবি অনুযায়ী আমরা যদি বনের জমি দখল করে চাষাবাদ করে থাকি, তাহলে আমাদের রোপণ করা ফসল কাটার আগে অন্তত একটা নোটিশ দেওয়ার দরকার ছিল। আমরা এ দেশের নাগরিক। একজন নাগরিকের বাগান হঠাৎ করে বন বিভাগ নষ্ট করবে এটা হতে পারে না। আমরা এর জবাব চাই।

আদিবাসী নেতা প্রাঞ্জল জানান, আগামী ৫ অথবা ৬ সেপ্টেম্বর তারা এ বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে বসতে চান। আলোচনা যদি ফলপ্রসূ না হয় তাহলে অস্তিত্ব রক্ষায় এ সংগ্রাম আরও জোরদার ও বেগবান করা হবে।

ইতোমধ্যে আদিবাসী সংগঠনগুলোর দাবির পক্ষে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মীরা। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-তত্ত¡ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন কনার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল শেরপুর সফর করে আদিবাসী নেতৃবৃন্দের সাথে ওইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।

আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভ‚মি কমিশন গঠন কারা দরকার উল্লেখ করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল বলেন, আদিবাসীদের প্রথাগত আইন যা আই এল ও কনভেনশন এবং জাতিসংঘ সনদ স্বীকার করে। সে অনুযায়ী আদিবাসীদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।

পাহাড়িদের বসত ভিটা ও আবাদি জমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার হুমকি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বালিজুড়ি রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম।

তিনি বলেন, বন আইনের নীতিমালা অনুযায়ী কাউকে বনাঞ্চলে সবজি চাষ করতে দেওয়া হবে না। যারা অবৈধভাবে বনে বাগান তৈরি করছে তা আমরা কেটে দিচ্ছি।

জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ বলেন, এ বিষয়টি সরকারের উর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করা হবে। সেখান থেকে আমরা যে সিদ্ধান্ত পাবো সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, এ নিয়ে কারো আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।