ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলার বাঙালি উন্মাদনার পিছনে কি দু’টি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দায়ী?

::রেজাউল করিম রেজা ::
আমরা বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণ প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলা নিয়ে কেন এতটা উন্মাদ, যেখানে কাছাকাছি ইউরোপের দেশগুলো নিয়েও ততটা নই? এই বিষয়ে আসলে কোন ঐতিহাসিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা সম্পৃক্ততা আছে কি? জানতে চান? তাহলে আপনাকে দু’টি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কিংবা বলতে পারেন ব্যাখ্যা আপনাকে বুঝতে হবে।

১৯১২ সালের দিকে জার্মান আবহাওয়াবিদ আলফ্রেড ওয়েগনার পৃথিবীর গঠন নিয়ে একটি চমৎকার তত্ত্ব প্রদান করেন যা মহীসঞ্চারণ তত্ত্ব বা Continental Drift নামে পরিচিত। যা বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকৃতি দিয়েছে যে এটি এখন আর নিছক কোনো তত্ত্ব নয়, বরং বিজ্ঞানসম্মত একটি ঘটনা, যা পৃথিবীতে সংঘটিত ভূমিকম্পের জন্য দায়ী বলে ভূবিজ্ঞানীরা গ্রহণ করেছেন।

তাহলে কি ছিল সেই তত্ত্ব আর সেটা কিভাবেই বা ব্রাজিল-আর্জেটিনার খেলার সাথে আমাদের উন্মাদনার সম্পৃক্ততা স্থাপন করে!

মি. ওয়েগনারের মতে বহুকাল আগে পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশ মিলে একত্রে একটি সুপার কন্টিনেন্ট ছিল যা প্যানজিয়া নামে পরিচিত। কালের আবর্তে প্যানজিয়ার প্লেটগুলো আলাদা আলাদা মহাদেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথমে প্যানজিয়া সুপার কন্টিনেন্ট প্রায় মাঝ বরাবর প্যান্থালাসা মহাসাগর দ্বারা বিভক্ত হয়ে লরেশিয়া (উত্তর অ্যামেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া) এনং গন্ডোয়ানাল্যান্ড (উত্তর অ্যামেরিকা, আফ্রিকা ও এরাবিয়া, ইন্ডিয়া সাবকন্টিনেন্ট, অস্ট্রেলিয়া ও এন্টারটিকা) নামক দু’টি বড় মহাদেশ গড়ে তোলে। পরে গন্ডোয়ানাল্যান্ড প্লেট বিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় উত্তর অ্যামেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এন্টারটিকা মহাদেশ)। এরও কয়েক কোটি বছর পর গন্ডোয়ানাল্যান্ডের একটি ক্ষুদ্র অংশ ইন্ডিয়ান প্লেট দ্বীর্ঘ সময় ভেসে এসে সজারো ধাক্কা দেয় এশিয়া মহাদেশকে এবং এই চাপের ফলে সৃষ্টি হয় অতিকায় হিমালয়ের, যে চাপে হিমালয় এখনো ওপর দিকে বর্ধমান। আর ভারতীয় উপমহাদেশ এশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার অনেক অনেক বছর আগে শুধুমাত্র ইরান উপদ্বীপ এশিয়ার সাথে যুক্ত হয়। এ থেকে ধারণা করা যায় আমরা পৃথিবীর গঠনগত দিক থেকে দক্ষিণ অ্যামেরিকার একটি অংশ হিসাবে এশিয়াতে এসেছি। আর বিজ্ঞান এটা বলে যে, কোন অঞ্চলের জীবের নানাবিধ বিবর্তন হলেও তাদের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী কিছু কিছু সহজাত প্রবৃদ্ধি (Intrinsic Meme) বহমান থাকে। তাহলে আমরা কি সেই ধারা বহন করছি?

অন্যদিকে মানুষের উৎপত্তিগত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলে প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার বছর পূর্বে বাঙালি জাতির উদ্ভব ঘটেছে। এ অঞ্চলে প্রথম আসে নিগ্রপ্রতিম খর্বাকায় মানুষ, যাদেরকে নেগ্রিটো বলা হয়। তারপর বিভিন্ন জাতি বর্ণের মিশ্রণে সৃষ্টি হয় সমগ্র বাঙালি জাতি। সমগ্র বাঙালি জাতিকে মোটাদাগে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: অনার্য জনগোষ্ঠী এবং আর্য জনগোষ্ঠী। অনার্য জনগোষ্ঠীকে মূলত নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয় এই চারটি শাখায় বিভক্ত ছিল।

অনার্য জনগোষ্ঠী প্রথম জনগোষ্ঠীর নাম নেগ্রিটো। এরাই ভীল, সাওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি উপজাতির পূর্বপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) থেকে বাংলায় প্রবেশে করে অস্ট্রিক জাতি। তারা নেগ্রিটোদের পরাজিত করে। বাংলাদেশের সাঁওতাল, বাঁশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি আদি অস্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পর্কিত।

অস্ট্রিক জাতির কিছু পরে বাংলায় প্রবেশ করে দ্রাবিড় জাতি। তারা আসে খাইবার গিরিপথ দিয়ে। সভ্যতায় তারা উন্নত বলে, অস্ট্রিকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। অন্যভাবে বলা যায় দ্রাবিড়রা অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করে ফলে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার সাথে তারা একাকার হয়ে যায়। দ্রাবিড়দের কিছু কাল পরে উত্তর পূর্বাঞ্চল দিয়ে বাংলায় আগমন ঘটে মঙ্গোলীয়দের। অস্ট্রিক-দ্রাবিড় জাতির সাথে মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয় জাতীর সংমিশ্রণ ঘটে। গারো, চাকমা, ত্রিপুরা, কোচ প্রভৃতি উপজাতি এ জনগোষ্ঠী ভুক্ত।

আর্যদের আদিনিবাস ছিল ইউরাল পর্বতের দক্ষিণে বর্তমান মধ্য এশিয়া (কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান) এবং ইরানে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে ককেশীয় অঞ্চলের শ্বেতকায় আর্যগোষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করে। ভারতে আগমনের অন্তত চৌদ্দশত বছর পর বঙ্গ ভূখণ্ডে আর্যদের আগমন ঘটে। আর্যরা সনাতন ধর্মালম্বী ছিল, তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল বেদ। স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আর্যগণ সাফল্য লাভ করে এবং বঙ্গ ভূখণ্ড দখল করে নেয়। পরবর্তীতে এরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যায়। এভাবে আর্য ও অনার্য আদিম অধিবাসীদের সংমিশ্রণে এক নতুন জাতির উদ্ভব হয়- যার নাম বাঙালি জাতি।

তবে বর্তমান সময়ের একটি সর্বাধুনিক গবেষণা আর্যদের থেকে ভারতীয় উপমহাদেশীয় জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ব্রিটিশ প্রদত্ত এ তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বংশগতিবিদ্যার অধ্যাপক ড. ডেভিড রাইখের লেখা বই ‘Who we are and How we got here’ এবং ভারতীয় উপমহাদেশীয়দের প্রাচীন বংশগতি নিয়ে ৯২ জন বিজ্ঞানীর একটি দলের সাম্প্রতিক গবেষণায় ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, মধ্য এশিয়ার দেশসমূহ থেকে সংগৃহীত ফসিলের জিনোম সিকুয়েন্স করে বিশ্লেষণে পাওয়া যায় ভারতীয় উপমহাদেশীয়দের সাথে আফ্রিকানদের ডিএনএ-এর মিল। আফ্রিকার এই মানুষগুলো এই উপমহাদেশে আসেন প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে। আর আর্যগণ আসে মাত্র তিন হাজার পাঁচশ বছর আগে। আর আর্যদেরও আগে আসে সভ্যতার সূতিকাগার খ্যাত পশ্চিম এশিয়া (বর্তমান মিশর, ইজরাইল, প্যালেস্টাইন, জর্ডান, সিরিয়া, ইত্যাদি) থেকে কৃষি অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত ইরানীরা অধিবাসীরা। তারা এসে আরও আগে থেকে আসা আফ্রিকান বংশধরদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গড়ে তোলে Ancestral South Indian (ASI) মানব গোষ্ঠী এবং এর অনেক পরে আর্যরা এসে উত্তর ভারতীয়দের সাথে মিশে যায় আর গড়ে উঠে Ancestral North Indian (ANI) মানব গোষ্ঠীর। এরপর আবার ASI ও ANI মিশে গড়ে তোলে মিশ্র ভারতীয় জাতী। এ মিশ্রণ বর্তমানেও বিদ্যমান।

তবে এ জন্যেই কি আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান ও ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোতে এত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলা নিয়ে উন্মাদনা? আসলে এটা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তবে একটা অদ্ভুত মিল দুই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই ইঙ্গিত করে আর তা হলো মহাদেশগুলো সৃষ্টির আগে দক্ষিণ অ্যামেরিকা, আফ্রিকা, আরব, ইরান, ভারতীয় উপমহাদেশ ভূগৌলিকভাবে এক ছিল, এক ছিল এই ভূমির জীবজগৎ। পৃথিবীর গতিশীল প্লেটের কারণে হয়তো আবার একদিন আমরা ফিরে গিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার প্রাচীন ভাইদের সাথে যুক্ত হবো, তাই তাদের আনন্দে-নিরানন্দে বহুদূর হতে আমাদেরও পুরানা সহজাত প্রবৃদ্ধি (Intrinsic Meme) জাগ্রত হয় আর কি। (বিঃ দ্রঃ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর আলোকে এটি একান্তই ব্যক্তিক বিশ্লেষণ)।

লেখক
রেজাউল করিম রেজা
ব্যাংকার

সূত্রঃ
Formation of Iranian Plateau: https://www.youtube.com/watch?v=4ge3kJna-Hg
ভারত কিভাবে সৃষ্টি হল? https://youtu.be/TncC-XbE4Jo
বাঙালি জাতির উৎপত্তির ইতিহাস । https://www.historytvbangla.com/2020/12/blog-post.html
আর্যরাই কি গড়েছিলো প্রাচীন ভারত? | How DNA is Rewriting India’s History | Think Bangla- https://youtu.be/sCgofiPoeew