বশেফমুবিপ্রবি : উচ্চশিক্ষায় নতুন দিগন্ত

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ॥ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর মানবসম্পদ এবং মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ গড়ার লক্ষ্যে জামালপুরে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেফমুবিপ্রবি)’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের স্মরণে তার নামে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব প্রদানসহ পঠন-পাঠন ও গবেষণার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বর্ষে পা দিয়েছে নতুন প্রজন্মের এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।

প্রযুক্তিনির্ভর একটি প্রজন্ম তৈরি করতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবহেলিত জেলা জামালপুরের প্রকৃতি ও জনপদে বিশ্বমানের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে দ্রুততার সঙ্গেই অগ্রসর হচ্ছে বশেফমুবিপ্রবি।

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০১৭’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর ওই বছরেই নবগঠিত বিভাগ ময়মনসিংহ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্বোধন করেন।

ওই সময় মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ আমাকে বশেফমুবিপ্রবির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর স্বল্প লোকবল নিয়ে ‘শূন্যে’ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আকৃতি দেওয়ার কাজ শুরু করি। এতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনসহ (ইউজিসি) সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর-বিভাগের কর্মকর্তারা। ভবিষ্যতেও মেলান্দহের সবুজ-শ্যামল প্রাকৃতিক পরিবেশে বশেফমুবিপ্রবির একটি আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন বলে আশা করি।

২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষাকার্যক্রম শুরুর পর এখন অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে পাঠদান চলে জেলা শহরের দেওয়ানপাড়ার বঙ্গবন্ধু আইডিয়াল কলেজের একটি ভাড়া ভবনে।

সীমিত সম্পদের মাঝেই সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সেখানকার শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে আধুনিক সুবিধাসহ ল্যাব। ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা যাতে ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ কানেক্ট হতে পারে সেজন্য উচ্চগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

লাইব্রেরি একটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্তম্ভ। তা বিবেচনায় নিয়ে ছোটপরিসরে লাইব্রেরিও স্থাপন করা হয়েছে; যেখানে রেফারেন্স বই ছাড়াও দেশি-বিদেশি জার্নাল ও বই পড়তে পারেন শিক্ষার্থীরা।

২০২০ সালে বছরজুড়ে বিশ্বব্যাপী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে বশেফমুবিপ্রবির লাইব্রেরিতে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপন করা হবে।

ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচের অর্থাৎ ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, নতুন বছরের ১ জানুয়ারি ওই শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হবে। পাশাপাশি প্রথম ব্যাচের সেমিস্টার পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। সব বিভাগেই ভালো ও আশানুরূপ ফল করেছেন আমাদের শিক্ষার্থীরা।

প্রথম ব্যাচে চারটি অনুষদের অধীনে চারটি বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এগুলো হচ্ছে- কম্পিউটার বিজ্ঞান প্রকৌশল, সমাজ কর্ম, গণিত ও ব্যবস্থাপনা। আর দ্বিতীয় বছরে যুক্ত করা হয়েছে নতুন বিভাগ তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল।

এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী, মানসম্মত শিক্ষাদান ও বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে উচ্চতর ডিগ্রিধারী ও মেধাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও জামালপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য মির্জা আজম। এখনও সার্বিকভাবে নানা সহযোগিতা করে চলেছেন তিনি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

গত একবছরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন উদযাপন ছাড়াও জাতীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন ও পালন করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নানা জনকল্যাণমূলক কাজেও অংশ নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বশেফমুবিপ্রবিকে একটি গবেষণানির্ভর ও আন্তর্জাতিকমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেভাবে পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হচ্ছে।

মেলান্দহে অবস্থিত শেখ ফজিলাতুন্নেছা ফিশারিজ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্তীকরণ করার প্রক্রিয়াও এখন শেষ পর্যায়ে। চলছে মূল ক্যাম্পাস স্থাপনের প্রক্রিয়াও।

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো বেশি শিক্ষার্থীদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে ভবিষ্যতে নতুন অনুষদের অধীনে যুগোপযোগী বিভাগ খোলা হবে।

স্থাপন করা হবে গবেষণাধর্মী ইনস্টিটিউট। থাকবে উন্নত ও আধুনিক সুবিধাসহ ল্যাবরেটরি। যেখানে জ্যেষ্ঠ/কণিষ্ঠ গবেষকরা যৌথ গবেষণা করবেন। সৃষ্টি করবেন নতুন জ্ঞান, যা মানুষের কল্যাণ বয়ে আনবে ও জীবন-যাপন সহজতর করবে।

শিক্ষার্থীদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য কোর্স পড়ানো হচ্ছে। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বশেফমুবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের সবার বাধ্যতামূলক হবে ব্যবহারিক কম্পিউটার।

সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের একটি ফ্রেমওয়ার্ক করে দিয়েছেন। তা হচ্ছে ভিশন ২০২১, ২০৩০, ২০৪১ এবং শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান।

এসব ভিশন বাস্তবায়ন করতে পারলেই বাংলাদেশ একটি উন্নত ও আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পাবে। এক্ষেত্রে আমাদের যে বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে।

এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বশেফমুবিপ্রবিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কেননা একাডেমিক গবেষণাকে সমৃদ্ধ করার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়াও মহাকাশ বিষয়ে গবেষণা, পরিবেশ-প্রতিবেশ অনুযায়ী বিষয়ে পঠন-পাঠন ও ব্যবস্থাপনার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। থাকছে দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সহযোগিতামূলক সমঝোতার বিষয়টিও।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসন্ন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এরই মধ্যে ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) মতো বিষয়গুলোর মাধ্যমে ঘটা এই বিপ্লব মোকাবেলায় কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরিকল্পনায় সরকারের আইসিটি বিভাগ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

আমরা এখন রোবটিক্স, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বা অদৃশ্য প্রযুক্তির কথা বলছি। এসব বিষয় মাথায় নিয়ে বশেফমুবিপ্রবি ভবিষ্যতে রোবোট্রিক্স ও মেকাট্রনিক্স এর মতো বিভাগ চালু করবে।

আমরা স্বপ্ন দেখি, একদিন বশেফমুবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে নেতৃত্ব দেবে। সমৃদ্ধ করবে দেশের ভবিষ্যত, উজ্জ্বল করবে বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের মুখ। সীমিত সম্পদের মাঝে তাদের সেভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে।

৫০০ একর জমির উপর নির্মিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস। সেখানে একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন, শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল, মসজিদ, খেলার মাঠ, সুপরিসর গ্রন্থাগার, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, জিমনেসিয়াম, টিএসসিসহ নানা স্থাপনা থাকবে। আন্তর্জাতিক গবেষক ও বিদেশি শিক্ষর্থীদের জন্য ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল নির্মাণ করা হবে।

যেহেতু নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে আমরা বিশ্বাস করি- শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় তা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাবে বশেফমুবিপ্রবি।

বশেফমুবিপ্রবি আইনটি যেহেতু ২৮ নভেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশ হয়, তাই ওইদিনটিই ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এবার প্রথম বর্ষের ভর্তিপরীক্ষা থাকার কারণে দিবসটি উদযাপিত হয়নি। তাই ৩১ ডিসেম্বর মহাসমারোহে দিনটি উদযাপন করছি আমরা।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই সোনালি দিন হলো বয়সে নবীন বশেফমুবিপ্রবির অর্জনকে আরো বেগবান, সফলতার পথে বাধা দূরীকরণ ও ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা পুনঃনির্ধারণ করে সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যয় গ্রহণের দিন।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর