৭ ডিসেম্বর ইসলামপুর মুক্ত দিবস

প্রয়াত জালাল কোম্পানির অধিনায়ক শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন

লিয়াকত হোসাইন লায়ন, ইসলামপুর প্রতিনিধি
বাংলারচিঠিডটকম

৭ ডিসেম্বর ইসলামপুর মুক্ত দিবস। ডিসেম্বর মাস বাঙালি জাতির গৌরবের মাস। ১৯৭১ সালের আজকের দিনেই জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার মাটি পাকহানাদার মুক্ত হয়েছে।

জানা যায়, ১৯৭১ সালে হাজার মুক্তিকামী ছাত্র জনতা আনন্দ উল্লাসের মধ্যে দিয়ে থানা চত্বরে প্রয়াত জালাল কোম্পানির অধিনায়ক শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন স্বাধীনতার প্রথম বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই দিনটি ইসলামপুরবাসীর জন্য অত্যন্ত গৌরবের।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত হোসেন স্বাধীনসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, যখন এই মাস আসে তখনই মনটা ফিরে যায় অতীতের সেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। বিশাল জনসমুদ্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কণ্ঠে ঘোষিত হয় বাঙালি জাতির বঞ্চনার ২৩ বছরের ইতিহাস। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

সে সময় উপজেলার উত্তর দরিয়াবাদ ফকিরপাড়ার সন্তান জালাল কোম্পানি অধিনায়ক বীর সন্তান শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে ওই সময় জয় বাংলা মন্ত্রে উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত হয়ে জামালপুর মহকুমাধীন ইসলামপুরসহ বিভিন্ন থানার সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা মুজাহিদ বাহিনীর শতাধিক সদস্য জে. জে. কে. এম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হয়।

এলাকার ছাত্র, যুবক ও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্যারেড ও বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। টাঙ্গাইলের মধুপুরে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অধিনায়ক আশরাফ ও শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০০ জন মুজাহিদ সদস্যদের নিয়ে জামালপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হন। তারা ওইদিন জামালপুরে পিটিআই ও মহিলা কলেজে অবস্থান নিয়ে জামালপুর ট্রেজারি থেকে ১০০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও গুলি সংগ্রহ করে প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রস্তুতি নেন। তারপর তারা ১৯ মার্চ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিদ্রোহ করে ময়মনসিংহে অবস্থানকারী সেক্টর অধিনায়ক এস ফোর্সের অধিনায়ক বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর নিদের্শনা ও নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন হাকিমের তত্ত্বাবধানে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর নামক স্থানের পাক হানারদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিরোধ ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন।

পাক হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্র ও বিমান হামলার মুখে টিকতে না পেরে ছত্র ভঙ্গ হয়ে পড়েন তারা। পাক হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল, মধুপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে ২২ এপ্রিল জামালপুর দখল করে নেয়। ২৭ এপ্রিল ইসলামপুর থানাও দখল করে নেয়।

পরর্বতীতে শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে টাঙ্গাইল প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে কিছু সংখ্যক মুজাহিদ সদস্য ও অন্যান্য লোকজনদের নিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে মহেন্দ্রগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে স্থাপিত প্রাথমিক রিক্রুট মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগদান করেন।

ক্যাম্পের ইনচার্জ করিমুজ্জামান তালুকদার এমএনএ, রাশেদ মোশারফ এমপিএ, আশরাফ হোসেন এমপি এর নির্দেশে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাক হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন ও মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে মতিউর রহমান মতি, গোলাম মোস্তফা, মাওলানা আনোয়ার হোসেন, শাহাদত হোসেন মজির উদ্দিন আহমেদ, পরিমল সেন (নারু বাবু), আব্দুল গণি সরদার, ইদ্রিস আলী বাহাদুর ও স্কাউট লিডার সুভাষ চন্দ্র দাস বিভিন্ন পেশার লোকজনদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন।

ভারতের মহন্দ্রেগঞ্জে রিক্রুটিং প্রশিক্ষণ শিবিরে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত অবস্থান করা হয়। বাছাইকৃত লোকদের তুরাসহ অন্যান্য স্থানে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অধিনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তারা বিভিন্ন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। ১২ আগস্ট কর্নেল আবু তাহের সেক্টর অধিনায়ক হিসাবে যোগদান করেন।

এ সময় ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন পেশার লোকজনদের নিয়ে জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়। সেক্টর অধিনায়কের নির্দেশ মোতাবেক ওই কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ইসলামপুর থানার সিরাজাবাদ এলাকার বহ্ম্রপুত্র নদীর পাড়ে মাদারি ছন আখ ক্ষেতে নামক স্থানে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।

সেখানে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ গেরিলা যুদ্ধ চালানো হয়। জালালের নাম অনুসারে জালাল বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে কোম্পানিটি। প্রতিদিন জালাল বাহিনী নিয়ে পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের স্থাপনা আক্রমণ করেন। অধিনায়ক জালাল উদ্দিন, আলা উদ্দিন জোদ্দার, মো. মমতাজ উদ্দিন, জয়নাল আবেদীন, এস এম কুদ্দুছ, নাগর আলী সুলতান মাহমুদসহ আমাদের পুরস্কৃত করেন।

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে জালাল বাহিনী ইসলামপুরের পাক হানাদার বাহিনী ক্যাম্প দখলে প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে ৬ ডিসেম্বর দুপুর পলবান্ধা ইউনিয়নের পশ্চিম বাহাদুরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ সংলগ্ন ইসলামপুর সিরাজাবাদ সড়কে অবস্থান নেয়।

মুক্তিযোদ্ধারা চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে এক প্লাটুন থানা পরিষদের উত্তর পশ্চিম কোণে ঋষিপাড়া রেলক্রসিং এলাকা, ২ নম্বর প্লাটুনকে সর্দারপাড়া অস্টমিটেক খেয়া ঘাট সংলগ্ন বহ্ম্রপুত্র নদের দক্ষিণ পাড় ইসলামপুর-সিরাজাবাদ সড়ক এলাকায়, ৩ নম্বর প্লাটুনকে থানার পূর্ব পাশে পাকা মোড়ি মোড় বর্তমানে ইসলামপুর হাসপাতাল সংলগ্ন সড়কে এবং ৪ নম্বর রিজার্ভ প্লাটুনকে পশ্চিম বাহাদুরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন উত্তর পাশে অবস্থান নেয়।

ওইদিন দুপুর থেকে পরেরদিন ভোর পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ হয়। হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলির দাপটে টিকতে না পেরে অস্ত্র গোলাবারুদ এবং অন্যান্য জিনিস পত্র ফেলে আকৎসিকভাবে রণে ভঙ্গ দিয়ে বিশেষ ট্রেনযোগে জামালপুরের দিকে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় ঝিনাই সেতুসহ তিনটি রেল সেতু ধ্বংস করে জামালপুর পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

অতঃপর ৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় থানা প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মজির উদ্দিন আহমেদ, গণি সরদার, টুআইসি আলাউ উদ্দিন জোরদার, প্লাটুন অধিনায়ক শাহাদত হোসেন স্বাধীন ও হাজার মুক্তিকামী ছাত্র জনতা আনন্দ উল্লাসের মধ্যে দিয়ে থানা চত্বরে জালাল কোম্পানির অধিনায়ক প্রয়াত শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন স্বাধীনতার প্রথম বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সাথে ইসলামপুরের মাটি শত্রুমুক্ত হয়।

উল্লেখ যে, বিশেষ জালাল কোম্পানি অধিনায়ক শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতুবরণ করেন।