যৌনপল্লীর সরদারনী ডলিকে প্রধান আসামি করে জামালপুর সদর থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছে। ২৬ অক্টোবর, রবিবার রাতে জামালপুর যৌনপল্লীর বন্দিদশা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসে দুই মেয়ে। আমরা খবর পেয়ে পুলিশসহ ঘটনাস্থল জামালপুর বাস টার্মিনালে যাই। ভয়ে কাতর ১৫ ও ১৬ বছর (মামলাসূত্রে) বয়সী দুই মেয়েকে মোল্লা কাউন্টার থেকে উদ্ধার করে থানা হেফাজতে রাখা হয়। ২৭ অক্টোবর, সোমবার মানবপাচার আইনের জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম, সরদারনী ডলির বরিশাল, খুলনা, জামালপুর বাইপাস, ওয়াপদা এলাকায় বহুতল ভবন আছে। বেপারীপাড়ায় আছে তার টর্চার সেল। সেখানে শিশু ও কিশোরীদের পাচার করে নিয়ে এসে যৌন নির্যাতন চালায়। অভ্যস্ত হওয়ার পার তাদের যৌনপল্লীতে এনে নির্মম কায়দায় দেহ ব্যবসা শুরু করেন। এসব মেয়েদের শুধু খাবার সরবরাহ করা হয়। প্রতিবাদ করলেই মেয়েদের উপর চলে দানবীয় নির্যাতন। এ অমানবিক ঘটনা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে।
আমরা নানাভাবে প্রতিবাদ করে আসছি, মানববন্ধন করেছি, স্মারকলিপি দিয়েছি। আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বলে আসছি মধ্যযুগীয় অপতৎপরতা বন্ধের জন্য। আমরা বলে আসছি একটা মেয়েও যাতে যৌনপল্লীতে প্রবেশ করাতে না পারে।
১৯৯৬ সাল থেকে আমার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে ৯৪ জন শিশু, কিশোরী ও প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের উদ্ধার করে তাদের নিজ নিজ ঠিকানায় অথবা সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠাতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি।
এই সভ্য জগতে বাংলাদেশের মত একটি মুসলিম রাষ্ট্রে যৌনপল্লীর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। প্রায় ২৫০ বছর আগে বৃটিশ বণিককদের মনোররঞ্জনের জন্য ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে রানীগঞ্জ যৌনপল্লী গড়ে উঠে। একসময় বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল যৌনপল্লীটি। কালের পরিক্রমায় এর আকার ছোট হয়ে এসেছে।
এখন এ নিষিদ্ধ পল্লীতে আছে ১১টি বাড়ি। ১৭৫টির মত ঘর। এখানে যৌন পেশার সাথে যুক্ত আছে প্রায় ১৩০ জন নারী। কর্মক্ষম বয়স্ক নারী আছে প্রায় ৪০ জন। তাদের মধ্যে ১৫-২০ জন আছে ছোট, মাঝারি ও বড় গোছের সরদারনী। সরদারনীদের ডিক্টেটরশিপে নিস্পেষিত হয় সাধারণ যৌনকর্মীরা। বাড়ি মালিকেরা আরও বেশি শোষকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। অস্বাভাবিক ঘর ভাড়া, বিদ্যুই বিল, পানির বিল নির্ধারণ করে থাকেন। এসব বিল পরিশোধে হেরফের করলেই চলে অত্যাচারের স্টিমরোলার। যৌনপল্লীতে চলে চড়া সুদে দাদন ব্যবসা। সাধারণ যৌনকর্মীরা দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যান।
সুদীর্ঘ বছর ধরে যৌনকর্মীদের জীবন স্টাডি করতে গিয়ে দেখেছি এবং শুনেছি এসব মেয়ের নিদারুণ জীবন যন্ত্রণার কাহিনী। কেউ ইচ্ছে করে অন্ধকার জগতে পা বাড়ায় নাই। প্রেমের ফাঁদে পড়ে, চাকরির প্রলোভনের শিকার হয়ে, এমন কি নাটকীয় বিয়ের ফাঁদে পড়ে যৌনপল্লীতে পণ্যের মত বিক্রি হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এই প্রক্রিয়া চলে আসছে।
তাদের মৃত্যু হলে জানাযা হয় না। গোরস্থানে মাটি হয় না। আমি পাঁচজন বৃদ্ধ মহিলাকে জানাযা এবং ফৌতি গোরস্থানে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। তাদের কোন ঠিকানা ছিল না।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে পৃথিবী যখন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ব্যবহার করে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তখন আমরা প্রশ্চাতে গমনের প্রতিযোগিতায় নেমেছি। যৌনপল্লীর পাশাপাশি ভাসমান যৌনকর্মীদের প্রতিরোধেও প্রশাসন এবং নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, জামালপুরে ৪৬০ জন নারী বাসাভাড়া নিয়ে, হোটেলে ডাক পেয়ে যৌন পেশার সাথে যুক্ত আছেন। তাদের পেছনে রয়েছে অনেক রাঘব বোয়াল। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
আমি জানি আমার এ লেখায় অনেকের গাত্রদাহ হবে। বিশেষ করে নারী পাচারকারী, দেহ ব্যবসায়ী, দালাল, বাটপারসহ যারা সুবিধাভোগী তারা লেখা পড়ে হয়ত আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে যাবেন। তবে এসব মাথায় রেখেই আমি লড়াই করছি। প্রায় ৩০ বছর ধরে আমি অধিকারভিত্তিক বিশেষ করে মানবাধিকার সংরক্ষণের আন্দোলনে নিরন্তর পথ চলছি। ঝুঁকি মোকাবেলা করছি মানুষের ভালবাসা পুঁজি করে। আমার এ সংগ্রাম চলছে, চলবেই আমৃত্যু কাল ধরে।
জাহাঙ্গীর সেলিম : সম্পাদক, বাংলারচিঠিডটকম 


















