অস্তিত্ব হারাতে বসেছে ইসলামপুরের কাঁসাশিল্প

কাঁসার তৈজসপত্র । ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

লিয়াকত হোসাইন লায়ন, ইসলামপুর প্রতিনিধি, বাংলারচিঠিডটকম: কাঁসা তৈরির টুং টাং শব্দ আর ক্রেতাদের পদভারে একসময় মুখরিত থাকতো জামালপুর ইসলামপুরের কাঁসারীপাড়া। এখানকার কাঁসার কদর ছিল দেশজুড়ে। ঐতিহ্যবাহী কাঁসাশিল্পটি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিল। সেই চিত্র এখন আর নেই। মেলামাইন ও প্লাস্টিকসহ সহজলভ্য নানা সামগ্রীর বাজারে টিকতে না পেরে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে ইসলামপুরের কাঁসাশিল্প।

ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ইসলামপুরের উত্তর দরিয়াবাদ ফকিরপাড়া গ্রামে কাঁসাশিল্প গড়ে ওঠে। পরে এলাকাটি কাঁসারীপাড়া নামে পরিচিতি লাভ করে। এক সময় ইসলামপুরের কাঁসাশিল্প বিশ্ববাজারে বেশ কদর ছিল। আজ থেকে দুই যুগ আগেও কোনো বিয়ে-শাদি, আকিকা, সুন্নতে খৎনাসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসাবে দেওয়া হতো কাঁসার জিনিসপত্র।

এছাড়াও কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চাকরিতে যোগদান কিংবা অন্যত্র বদলির সময় এমনকি কোনো এমপি-মন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও তাদের সংবর্ধিত করা হতো কাঁসার তৈরি সামগ্রী দিয়ে। এসব নানা কারণে ক্রমেই কাঁসার জিনিসপত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সারাদেশ থেকে কাঁসা ব্যবসায়ীরা কাঁসা সামগ্রী কিনতে ভিড় জমাতো ইসলামপুরে। কাঁসার কারখানাগুলোতে কারিগররা দিনরাত কাজ করেও কাঁসা সামগ্রী সরবরাহে হিমশিম খেতো।

কাঁসাশিল্পীদের নিপুণ হাতের তৈরি কারুকার্য নান্দনিক কাঁসা একসময় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে স্থান করে নিয়েছিল সুদূর লন্ডনে। তৎকালীন বৃটিশ সরকার ১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহাম শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। ওই প্রদর্শনীতে ইসলামপুরের কাঁসাশিল্পের কারিগর স্বর্গীয় জগৎচন্দ্র কর্মকার ইসলামপুরের কাঁসার তৈজসপত্রাদি প্রদর্শন করেছিলেন এবং তা সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প হিসাবে স্বর্ণপদক লাভ করে। এরপর থেকে সারা বিশ্বে ইসলামপুরের কাঁসাশিল্পের পরিচিতি ঘটে।

কাঁসার তৈজসপত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি। ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে পাঠ্যপুস্তকেও স্থান করে নেয় ইসলামপুরের কাঁসাশিল্প। কাঁসাশিল্প কারখানায় কর্মরত কারিগররা জানান, কাঁসা হলো একটি মিশ্র ধাতব পদার্থ। কপার বা তামার ৮০০ গ্রাম এর সাথে টিনএ্যাংগট ২০০ গ্রাম মিশিয়ে আগুনে পুড়ালে ১ কেজি কাঁসা তৈরি হয়।

এছাড়া তামা, দস্তা, রাং বা অন্যান্য ধাতব পদার্থ মিশ্রণের ওপর নির্ভর করে এ শিল্পের স্থায়িত্ব, স্বচ্ছতা, মসৃণতা ও উজ্জ্বলতা। উল্লেখযোগ্য কাঁসার তৈজসপত্রাদির মধ্যে কাস্তেশ্বরী, রাজভোগী, রাঁধাকান্তি, বংগী, বেতমুড়ি, চায়নিজ, মালা, দরাজ, রাজেশ্বরী, রত্নবিলাস, ঘুটা ও কলতুলা নামে রয়েছে থালা ও গ্লাস। স্বন্দেশ গ্লাস নামে একটি বিশেষ গ্লাস তৈরি হয়। এই গ্লাসটিতে চার পার্ট রয়েছে। ১ম পার্টে পানি, ২য় পার্টে মিষ্টি, ৩য় পার্টে পানসুপারী, ৪র্থ পার্টে পান মসলা একই সাথে রাখা যায়। কৃষ্ণচূড়া, ময়ুরকণ্ঠি, বকঠোঁট, ময়ুর আঁধার, মলিকা ইত্যাদি নামে পাওয়া যায় জগ। সাদাবাটি, কাংরিবাঠি, বোলবাটি, রাজভোগী, রাঁধেশ্বরী, জলতরঙ্গ, রামভোগী, গোলবাটি, কাজল বাটি, ঝিনাই বাটি, ফুলতুলি বাটি, মালা বাটি ইত্যাদি নাম রয়েছে বাটির নাম। বোয়াল মুখী, হাতা, চন্দ্রমুখী, চাপিলামুখী, পঞ্চমুখী, কবুতর বুটি, ঝিনাইমুখী ইত্যাদি নামে পাওয়া যায় চামচ।

এছাড়াও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির বাহিরে রয়েছে কাঁসার তৈরি নানা সামগ্রী। পূজা-অর্চনায় মঙ্গল প্রদীপ, কোসাকুর্ষি, মঙ্গলঘট, ইত্যাদি কাঁসার বাদ্যযন্ত্র উল্লেখ্যযোগ্য। সেকাল থেকেই বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশের মানুষজন ওইসব তৈজসপত্র বড় দরদ দিয়েই পারিবারিক ও ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করে আসছেন।

কাঁসার তৈজসপত্র ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি। ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এ শিল্পের সাথে বেশি জড়িত ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ শিল্পের সাথে জড়িত অনেকেই দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যায়। পাকহানাদার বাহিনী কাঁসাশিল্পের সাথে জড়িতদের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর ক্ষুদ্র অংশ দেশে ফিরে আসে। নানা প্রেক্ষাপটে কাঁসা কর্মকারের সংখ্যা কমতে থাকে। এরপর নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর ধরন বদলে যাওয়ায় এ শিল্পে ধ্বস নেমেছে। গত ১৫ বছরে কাঁসা-পিতলের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। কাঁচামাল ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারছে না এ শিল্পটি।

নারায়ণ কর্মকার জানান, আগের মতো অর্ডার নেই তাই প্রায় সময় হাতে কাজ থাকেনা। তাই পরিবার পরিজন নিয়ে অভাব অনটনের মধ্যে দিন কাটালেও পৈত্রিক পেশার মায়ায় পেশাটি ছাড়তে পারছিনা। অনেকেই টিকতে না পেরে নানা পেশায় চলে গেছে। পৈত্রিক পেশা আঁকরে ধরে থাকা প্রায় ২০/২৫টি পরিবার আজও কাঁসাশিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে।

কাঁসাশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক অংকন কর্মকার জানান, কাঁসার নানা উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। তবে ক্রেতারা উচ্চমূল্যে খরিদ করতে চায় না। তাই বর্তমানে এ শিল্পের চরম দুর্দিন চলছে। অনেকেই বাঁচার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। তবে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা পেলে ডিজিটালাইজ পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে এ শিল্পটিকে আরো উন্নত করা যাবে এবং শিল্পটির হারানো ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তানভীর হাসান রুমান জানান, ঐহিত্যবাহী কাঁসাশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কাঁসাশিল্পের সাথে জড়িতদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিজনকে ১৮ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান বলেন, ইতিমধ্যে কাঁসাশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের মাঝে উপকরণ বিতরণ ও কমন সার্ভিস সেন্টারের উদ্বোধন করেছি। এই শিল্পের উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পর্যটন মন্ত্রণালয় ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়-সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহকে যুক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।