শেরপুরে আদিবাসী দিবস উদযাপন : উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ, সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের দাবি

উদীচী শিল্পী তৌহিদা স্বাধীনের নেতৃত্বে স্থানীয় আদিবাসী শিল্পীদের পরিবেশনায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতি, হুমকির মুখে থাকা ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে শেরপুরের সীমান্তবর্তী তিন উপজেলায় বসবাসকারী আদিবাসীরা। ১১ আগস্ট বিকালে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় এ দাবি করা হয়।

জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার বড় গজনী এলাকায় বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠি সংগঠন ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম জনউদ্যোগসহ ১৭টি সংগঠনের উদ্যোগে গঠিত ‘আদিবাসী দিবস উদযাপন কমিটি’ যৌথভাবে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।

‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়, আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান’ এ স্লোগানকে সামনে রেখে ওই সভা থেকে জেলার পাহাড়ি জনপদের বনাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বন্ধ, সমতলে বসবাসকারী আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য জেলায় একটি কালচারাল একাডেমি স্থাপনের দাবি জানানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

আদিবাসী নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হরলাল বর্মণের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লরেন্স বনোয়ারি। মিঠুন কোচের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঝিনাইগাতী টিডাব্লিও এর সাধারণ সম্পাদক অসীম ম্রং, কোচ আদিবাসী ইউনিয়ন জেলা সভাপতি রয়েল কোচ, নারী নেত্রী আইরীন পারভীন, জনউদ্যোগ আহ্বায়ক ও শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ, উদীচী জাতীয় পরিষদ সদস্য এস এম আবু হান্নান, কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি সোলায়মান আহমেদ।

এছাড়া আদিবাসী নেতা সুজল সাংমা, অনেশ রাংসা, পিন্টু নেংমিনজা, সুমন্ত বর্মন, যুগল কিশোর কোচ, পবিত্র বর্মন, মিখায়েল নেংমিনজা লক্ষণ বর্মন, সাংবাদিক হাকিম বাবুল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

আদিবাসী নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লরেন্স বনোয়ারি বলেন, একাত্তরে পাকবাহিনী আমাদের দমাতে পারেনি। আমরা স্বাধীনতা এনেছি। বাঙালি-আদিবাসী সবাই মিলে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। কিন্তু এখন নিজ দেশে, পরবাসীর মতো হয়ে গেছি। আমরা আদিবাসীর স্বীকৃতি চাই। জমির ওপর আমাদের ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকারের অধিকার চাই। এজন্য সবাইকে আজ ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলতে হবে। যাতে সরকার আদিবাসীদের দাবি আদায়ে বাধ্য হয়।

আদিবাসী নেতা সুমন্ত বর্মন বলেন, শেরপুর অঞ্চলে গারো, কোচ, হাজং, বর্মন, বানাই, ডালু ও হদিসহ ৭টি নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির বসবাস। কিন্তু এসব নৃ-গোষ্ঠির মধ্যে গারো, কোচ, হাজং এবং ডালু জনগোষ্ঠির নিজস্ব ভাষা থাকলেও কালের বিবর্তনে কোন ধরনের বর্ণমালা সংরক্ষিত না হওয়ায় মুখে মুখে প্রচলিত ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। ভাষার সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি। স্থানীয় নৃ-তাত্তি¡ক জনগোষ্ঠির ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে জেলার পাহাড়ি জনপদে ‘আদিবাসী কালচারাল একাডেমি’ স্থাপন এখন সময়ের দাবি।

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীবৃন্দ। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

সুজল সাংমা বলেন, আদিবাসীরা সবসময় বিভিন্নভাবে বৈষম্য ও শোষণের শিকার হয়ে আসছে। শেরপুরের পাহাড়ি জনপদে বসবাসকারী অনেক আদিবাসীর জমি জবরদখল করে নেয়া হয়েছে। আমাদের বাপ-দাদার ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, আদিবাসীদের সন্তানদের মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। অবিলম্বে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকার জমি থেকে উচ্ছেদ বন্ধ এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করতে হবে।

রয়েল কোচ বলেন, তালুকদার বাড়ি থেকে দাস বাড়ি হয়ে এখন আমরা আদিবাসীরা নাই বাড়ি হয়ে যাচ্ছি। যুগ যুগ ধরে বনাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের এখন বনবিভাগের পক্ষ থেকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছে। এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মানা হবে না। বাপ-দাদা, পূর্ব পুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না। এজন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হলেও করবো।

শেরপুর পুলিশ লাইন্স একাডেমি ফর ক্রিয়েটিভ এডুকেশনের প্রধান শিক্ষক ও জনউদ্যোগ আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, জাতিবৈচিত্রে বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে দেশের সকল নাগরিকের মাঝে আদিবাসীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। দেশের উন্নয়ন ধারায় সামগ্রিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে আদিবাসীদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।

উদীচী শিল্পী তৌহিদা স্বাধীনের নেতৃত্বে স্থানীয় আদিবাসী শিল্পীদের পরিবেশনায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। পরে শোকের মাস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যবর্গসহ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকারী আদিবাসী নেতৃবৃন্দের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করা হয়।

এরপর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী দুইজন আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা হরলাল বর্মন এবং লরেন্স বনোয়ারির হাতে জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান নাসরিন রহমানের দেওয়া উপহার সামগ্রী তুলে দেওয়া হয়। পরে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে জেলা পরিষদের দেওয়া করোনা সুরক্ষা সামগ্রী মাস্ক, স্যানিটাইজার ও সাবান বিতরণ করা হয়।

আলোচনা সভা শেষে বৈশ্বিক করোনা মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় জন্য সার্বজনীন প্রার্থনা করা হয়। প্রার্থনা পরিচালনা করেন গজনী গির্জাঘরের পাস্টার জনার্দন বনোয়ারি।

অন্যদিকে আদিবাসীদের দাবির প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, পাহাড়ি জনপদের আদিবাসীদের আতঙ্কিত ও চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। যদি কোনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ভূমিহীন কিংবা ঘরহীন থাকে, তাদের মুজিববর্ষের অঙ্গীকার অনুযায়ী ঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে।