সবার মনে হয়তো একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ‘ইজরাইল এতো তাড়াতাড়ি যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলো কেন?’ এটা যতটা না প্রশ্ন তারচেয়ে বেশি হলো শঙ্কা। ২০১৪ সালে তারা হামাসের সাথে যুদ্ধের বুলি আওড়িয়ে সাত সপ্তাহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। মিশরের মধ্যস্থতায় এবারের যুদ্ধ বিরতি আপাতত দৃষ্টিতে সাময়িক শান্তি আনলেও ইজরাইলের পরিকল্পনা ও যুদ্ধ বিরতির পিছনের গল্প অন্যরকম। এবারে ১১ দিনের মাথায় যুদ্ধ বিরতি করার কারণগুলোকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমত আন্তর্জাতিক চাপঃ ইজরাইল তাদের জন্ম লগ্ন থেকে এ যুদ্ধের আগ পর্যন্ত কখনোই এতটা আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে নি। মূলত যুদ্ধ বন্ধের চেয়ে বেশি চাপ ছিল ফিলিস্তিনি শিশু, নারী ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যা, বেসামরিক মানুষের বহুতল ভবন, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ফিলিস্তিনি অফিস ক্ষেপনাস্ত্র হামলা করে ধ্বংস করে দেওয়ায়। এমনকি একমাত্র করোনাভাইরাস টেস্টিং সেন্টার পর্যন্ত তারা বোমা মেরে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইজরাইলের সাথে সাথে চাপে পড়েছিল বাইডেন প্রশাসন। ডেমোক্রেট দলের একাধিক সিনেটরসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতি-নির্ধারক বাইডেন প্রশাসনকে চাপে ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে নজর কেড়েছে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত কংগ্রেসের আইনপ্রণেতা রাশিদা তালিব যিনি মিশিগান রাজ্যের ডেট্রয়েটে ফোর্ডের গাড়ির কারখানা পরিদর্শনে আগত জো বাইডেনকে সরাসরি জেরার মুখে ফেলেন। এরপর একে একে আরও অনেকেই এ বিষয়ে সরাসরি মুখ খোলেন এবং এ আগুনকে আরও উসকে দেয় যুদ্ধের মধ্যেই ইজরাইলের কাছে বাইডেন প্রশাসনের ৭৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত। তবে সবচেয়ে বিতর্কিত হয়েছে সব মার্কিন প্রেসিডেন্টের পুতুল কথা ‘ইজরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও বাইডেন প্রশাসনের অনেকে এর কড়া সমালোচনা করেছেন। নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য তো এক্ষেত্রে সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দেন ‘তাহলে ফিলিস্তিনিদের কি বেঁচে থাকার অধিকার নাই’? এক্ষেত্রে টুইটারে অনেকেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। ডেট্রয়েটে স্বরণকালের ইতিহাসে নানা ধর্ম-বর্ণের তিন লাখ মানুষের বৃহৎ সমাবেশ দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক, সানফান্সিসকোসহ অন্যান্য বড় শহরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ ইজরাইলের বিপক্ষে সমাবেশ করে।
এছাড়াও যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, সুইডেন, বেলজিয়াম, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, জর্ডান, মিশর, ইয়েমেন, কুয়েত, ইরাক, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারতের কাশ্মির, বাংলাদেশসহ অনেক দেশে লাখ লাখ মানুষ ইজরাইলবিরোধী মিছিল ও সমাবেশে অংশগ্রহণ করে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য শ্লোগান দেয়। কয়েকটি স্থানে সংঘাতের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। একক কোন আন্তর্জাতিক ইস্যূতে এ বিক্ষোভ-সমাবেশগুলো এ পর্যন্ত সর্ববৃহৎ হিসাবে মনে করা হচ্ছে। এতে করে ‘ইজরাইলে আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে’ বুলি আওড়ানো অনেক দেশ পরে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট, আয়ারল্যান্ডের মন্ত্রী, কানাডার আইনপ্রণেতা, চীনের প্রতিনিধি, তুর্কি প্রেসিডেন্ট, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা, রাশিয়ার, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেই ইজরাইলকে সন্ত্রাসী ও বর্ণবাদী আখ্যা দিয়ে করা তীব্র সমালোচনার করেন। জাতীসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি সদস্যদের চাপ বৃদ্ধি পায় এবং শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘ জরুরি ভিত্তিতে সাধারণ সভা আহ্বান করে পরিস্থিতির দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা চালায়।
আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম ছিল বিভিন্ন সামাজিক সাইটগুলোতে নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফিলিস্তিনিদের প্রতি সরব প্রচারণা। এছাড়াও কোটি কোটি নেটিজেন প্রতিনিয়ত সরাসরি লাইভ ও রেকর্ডকৃত ভিডিও, ছবি দেখে সরাসরি ইজরাইলের কড়া সমালোচনা করে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নিজেদের রায় দেন। যুক্তরাষ্ট্রের সুপার মডেল বেলা হাদিদ ও জিজি হাদিদ তো নিউইয়র্কের বিক্ষোভ সমাবেশে সরাসরি অংশগ্রহণ করে ইজরাইলি সরকারের তোপের মুখে পড়েন। এছাড়াও ট্রেভর নোয়াহ, রজার ওয়াটার্স, মার্ক রাফালো, লরেন জাউরেগি, উইল পটার, জন অলিভার, ইথান ক্লেইন, ফিলিপ ডেফ্রাংকোসহ আরও অনেক আন্তর্জাতিক জনপ্রিয় মডেল, অভিনেতা, গায়করা সরাসরি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সোসাল মিডিয়াতে সরব প্রচারণা চালান। এক্ষেত্রে অন্যতম আকর্ষণ ছিল ফিলিস্তিনের সমর্থনে অর্থডক্স ইহুদিগণের সমাবেশ।
সবচেয়ে নজরকাড়া ব্যাপার হলো এতদিনকার পাশ্চাত্যের প্রধান মিডিয়া মোঘলদের পর্দাযুক্ত খবর পরিবেশনকে এক হাত দেখিয়ে ফিলিস্তিনে কি হচ্ছে তার প্রকৃত রূপ সরাসরি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে প্রকাশ করে দিতে মতো তুর্কি ও মধ্যপ্রাচ্য ঘেঁষা নিউজ চ্যানেল আল জাজিরা, টিআরটি ওয়ার্ল্ড, এজে+, এ নিউজ, আরব নিউজ, মিডল ইস্ট আই, সোপবক্স, আনাদলু এজেন্সির সাথে রাশিয়ার টিআর লাইভসহ আরও অনেক চ্যানেল সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে তাদের লাইভ ভিডিও, ডকুমেন্টারি, ছবি ও খবর চোখে আঙ্গুল দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে দেখ এতদিন কি হয়েছে আর তোমরা কি দেখেছ। তারা ইজরাইলের হত্যাযজ্ঞ দেখানোর পাশাপাশি মানুষের কাছে এ বার্তা পরিষ্কার করতে পেরেছে যে এ ফিলিস্তিনিদের লড়াই এন্টিসেমিটিজম নয় বরং এন্টিজায়োনিজম। মূলত এইসব মিডিয়ার জন্যই মানুষ প্রকৃত ঘটনা জানতে পারে এবং বিক্ষুদ্ধ হয়।
যুদ্ধ বিরতির দ্বিতীয়ত অন্যতম কারণ হামাসের শক্তিমত্তার নব উত্থান। এবারের যুদ্ধে হামাস শুধু প্রযুক্তিগতভাবে না বুদ্ধির খেলায় এগিয়ে ছিলো। বিশ্বের সেরা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইজরাইলের আয়রন ডোমের দুর্বলতা খোঁজে বের করে তা কাজে লাগিয়ে ইজরাইলে যে চার হাজার রকেট ছুড়ে তার কয়েকটি বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। তাতে যতটা না ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি করেছে তারচেয়ে বেশি সৃষ্টি করতে পেরেছিল সাধারণ ইজরাইলিদের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক। হামাসের একের পর এক রকেট ছোড়ার ফলে ইজরাইলের আয়রন ডোম বিকট শব্দে সাইরেন বাজানোর সাথে সাথে সাধারণ ইজরাইলিরা প্রাণ ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। তারা আয়রন ডোমের ওপর আস্থা রাখতে পারছিল না। আর হামাস তাদের রকেটগুলো বেশির ভাগ রাতে ইজরাইলিদের ঘুমানোর সময় ছুড়ে। এক্ষেত্রে নিরাপত্তার আয়রন ডোম আতঙ্কের কারণ হিসাবে আভির্ভূত হয়। এতে ইজরাইলের অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
অন্যদিকে চারদিক দিকে অবরুদ্ধ গাজায় হামাস কিভাবে তাদের অস্ত্রের উন্নয়ন ও মজুত এত বৃদ্ধি করলো এটাও ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের মাথা ব্যাথার সৃষ্টি করেছে। হামাসের দাবি মতে তাদের হাতে ৬ মাস যুদ্ধ চালানোর মতো রকেট ও অন্যান্য অস্ত্রের মজুদ আছে। তাদের দাবি যে মিথ্যা না তা একদিনে একসাথে তিন হাজার রকেট ছুড়ে এবং ইজরাইলি জাহাজ ও তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কেন্দ্রে মানববিহীন ড্রোন সাবমেরিন হামলা করে সে সক্ষমতা তারা জানান দিয়েছে। হামাসের সামরিক শাখা ইজ আদ-দীন আল কাসসাম ব্রিগেড আগে চেয়ে অনেক শক্তিশালী ও কৌশলী প্রমাণ করেছে। এর ফলে ইজরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করতে বাধ্য হয়। কারণ এতে ইজরাইলি সৈন্যদের হতাহতের হার চরমভাবে বেড়ে যেত। আর লেবানন সিমান্তে হিজবুল্লাহ তো রকেট ছুড়ে তাদের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছিলো।
শেষ যে কারণ যুদ্ধ বিরতিতে প্রভাব ফেলেছে আর তা হলো ইজরাইলি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দুরাবস্থা। ইজরাইলি রাজনীতির মাঠ মূলত লেবার জায়োনিস্ট, রিভিশনিস্ট জায়োনিস্ট, রিলিজিয়াস জায়োনিস্টের মতো এলিট শ্রেণির ছাড়াও নন-জায়োনিস্টের অর্থডক্স জুডাইডিজম পার্টি, ধর্ম নিরপেক্ষ বাম পহ্নি, জায়োনিস্টবিরোধী ইসরাইলী আরব পার্টির মতো মোটামুটি ১২টি ব্লকে বিভক্ত। সেমেটিজম বলতে ইহুদি, হিব্রু, ইজরাইলি আরব, আসিরিয়ান ও অস্ট্রোনেশিয়ান মানুষদের কৃষ্টি-প্রথা ও ধর্মের বুঝালেও জায়োনিজম বলতে শুধু উগ্র রাজনৈতিক জায়োনিস্ট ইহুদিদের দলকে বুঝায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একজন উগ্রবাদী জায়োনিস্ট যিনি মূলত দুর্নীতির অভিযোগে গত এপ্রিলের নির্বাচনে পর্যাপ্ত সংখ্যক আসন না পাওয়ায় তৃতীয়বারের নির্বাচনে বেনি গান্টজের ব্লু এন্ড হোয়াইট পার্টির সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে এবং নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ব্যর্থতা ঢাকতে এই যুদ্ধের শুরু করে। এতে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা আরও তলানিতে ঠেকে, বিরোধীদলের অনেকেই কড়া সমালোচনা করে ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে এই যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য করে।
এখন প্রশ্ন হলো এই যুদ্ধ বিরতি কতদিন টিকবে?
এটা বুঝতে হলে আমাদের এতটুকু জানতে হবে যে, ইজরাইলি রাষ্ট্রের প্রকৃতরূপ রেখা প্রকাশ পায় আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে। ১৯১৭ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পরারাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্রের ঘোষণার পর পরই। জায়োনিস্ট ইহুদিরা মূলত আগ্রাসনবাদ ও উপনিবেশবাদ নীতিতে ভর করে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মদিনা, মিশর, উত্তর কুয়েত, ইরাক ও খাইবার অঞ্চল নিয়ে ইজরাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। পৃথিবীতে বর্তমানে একমাত্র চলমান উপনিবেশ হলো জায়োনিস্ট উপনিবেশবাদ বা ইজরাইলি রাষ্ট্র। আর যে কারণে তারা দুই রাষ্ট্র তত্ত্ব, অসলো চুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার ও জাতিসংঘের রেজুলেশনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে তারা নিরিহ ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে একের পর এক ভূমি দখল করে নিচ্ছে।
অতএব যায়, ইজরালের দিক থেকে এই যুদ্ধ বিরতি সাময়িক। আর প্রতি বছর রমজান মাসে ফিলিস্তিনে হামলা চালানো তাদের নিয়মিত রুটিন। এই যুদ্ধ বিরতি দেওয়ার পিছনে তাদের মূল পরিকল্পনাগুলো হলো- আয়রন ডোমের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আরও আপডেট, হামাসের শক্তিমত্তা সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ, আন্তর্জাতিক লবিস্টদের দ্বারা আরও রাজনৈতিকভাবে নিজেদের আরও সুবিধাজনক অর্জন, নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সমাঝোদা বাড়ানো এবং সবর্শেষ সময়মতো আবার হামলা চালানো। হামাস থাক বা না থাক। আর এটা ততদিন চলবেই যতদিন আমার আগের লেখায় চীনের দ্বিতীয় বিশ্ব গড়ে না উঠে কিংবা মসীহ ঈসা (আ.) না আসেন।
রেজাউল করিম রেজা
ব্যাংকার, ঢাকা।