মানবাধিকার দিবস : বেইজিং ঘোষণার ২৫ বছরে নারীর অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলারচিঠিডটকম

মানবাধিকার দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ ও আর্টিকেল নাইনটিন যৌথভাবে এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ২৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ‘বেইজিং ঘোষণার ২৫ বছরে নারীর অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক একটি অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করে। নারী অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও আইনজীবীগণ এই আলোচনায় অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে নারীর মানবাধিকার রক্ষায় ‘বেইজিং ঘোষণার’ ২৫ বছরে নারীর অগ্রগতি ও ঝুঁকি, জনজীবন ও ব্যক্তিজীবনে নারীর সমঅধিকার, প্রচলিত সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, প্রথা, ঐতিহ্য ও আইন-কানুনে নারীর প্রতি বৈষম্য বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। আলোচনার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিজীবন থেকে জনজীবন সর্বত্র নারীর মানবাধিকার, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনগতভাবে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকার বিষয়গুলো উঠে আসে।

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম, এনডিসি। সঞ্চালনা করেন আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল । এতে প্রধান আলোচকের বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক। এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য এবং কমিশনের মহিলা ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি জেসমিন আরা বেগম ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মোহাম্মদ জাকারিয়া।

অনুষ্ঠানে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন ও নীতিমালার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের গুরুত্ব, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় ও উত্তরণের বিভিন্ন দিক আলোচনায় তুলে ধরা হয়। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, অসমতা ও সহিংসতা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, নতুন নীতি ও আইনের পক্ষে সমর্থন জোগাড় এবং প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত জীবন উভয় ক্ষেত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারি-বেসরকারি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার উপর তারা জোর দেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম, এনডিসি বলেন, ‘যেকোন দুর্যোগ, যুদ্ধ ও মহামারিতে নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হন। এই করোনার মত মহামারির সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ শনাক্ত করার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কাজ করছে। ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করার পরেও দেশে ধর্ষণ কমেনি। নারীর অধিকার রক্ষায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, সন্তানদের প্রতি মা-বাবার যত্নশীল হতে হবে, ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ করতে হবে, নারীকে শোষণ করার মনোভাব পরিহার করতে হবে। মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দেশের প্রত্যেক উপজেলায় মানবাধিকার সুরক্ষা ক্লাব করতে চায় যার সদস্য হবে স্কুল কেবিনেটের সদস্য ও কলেজের শিক্ষার্থীগণ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, ‘বেইজিং ঘোষণার ২৫ বছরে নারী-পুরুষের সমঅধিকার চর্চা এবং পুরুষতান্ত্রিক অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য নারী অধিকার আন্দোলন তাত্ত্বিকভাবে যতটুকু এগিয়েছে প্রায়োগিকভাবে ততটা অগ্রসর হয়নি। শিক্ষায়, কর্মে, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি হলেও, অনেক ক্ষেত্রে নারীরা এখনও পিছিয়ে। অধিক সংখ্যক নারী কর্মক্ষেত্রে সংযুক্ত হলেও অধিক সংখ্যক পুরুষ গৃহস্থালি কাজে সংযুক্ত হয়নি। ফলে নারীকে ঘর-বাহির দুই ক্ষেত্রের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এর কারণে কর্মজীবী নারীরা বিশ্রামের সুযোগ কম পান। দেশের উন্নয়নের সংখ্যাবাচক পরিমাপের সাথে গুণবাচক পরিমাপ যেমন সুখ, নিরাপত্তা, পরিতৃপ্তি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নারীদের সমঅধিকারের সাথে দায়িত্ব নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে এবং নারী অধিকার আন্দোলনে পুরুষদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘মানুষ হিসেবে নারীর সম্মান-মর্যাদা এখনও পরিপূর্ণ স্বীকৃতি পায়নি। নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন ও মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠিত নারী তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারলেও অধিকাংশ নারী আজও শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। নারীর প্রত্যেকটি কাজের স্বীকৃতি না থাকার কারণে তারা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশের সদস্য ও মানবাধিকার কমিশনের মহিলা ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি জেসমিন আরা বেগম বলেন, ‘ইন্টারনেটের অপব্যবহার ও বিদ্যমান সমাজ বাস্তবতায় মানুষের মন বৈকল্য ঘটছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে পরিপূর্ণ অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যারা ধর্ষণ করছে, তাদের সাথে কথা বলে কেন এ ধরনের কাজ তারা করে সেটা জানাটাও জরুরি। অর্থাৎ এ ধরনের ঘটনার রুট কজ আমাদের জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী সমস্যার সমাধানে কাজ করতে হবে।’

এশিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘করোনাকালে নারী ও মেয়ে শিশুদের ওপর অত্যাচার-সহিংসতা বেড়েছে। করোনা আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের অবস্থান পুনঃমূল্যায়ন করার সুযোগ করে দিয়েছে। বেইজিং ঘোষণার আলোকে নতুন করে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সম্ভব হবে।’

আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ঘোষিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু বাস্তবে নারীরা একজন মানুষ হিসেবে তাদের জন্য প্রদত্ত অধিকারগুলো পুরুষের মতো সমভাবে ভোগ করতে পারে না। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ ও ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষ ও বালকদের সম্পৃক্ততা যেমন জরুরি তেমনি হিজরা, তৃতীয় লিঙ্গ ও এলজিবিটিকিউআইদের অধিকারের স্বীকৃতি অকপটে নিশ্চিত করতে হবে।’

আর্টিকেল নাইনটিন সমাজের সকলক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সমতা নিশ্চিতকরণ এবং নারী ও মেয়েশিশুদের অধিকার, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায়।

আর্টিকেল নাইনটিন যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাজ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংস্থাটি ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।