জামালপুর সদর হাসপাতালে প্লান্টের অক্সিজেন গ্যাস নির্গমনে রোগীর মৃত্যু, প্রাণভয়ে সব রোগীরা বাইরে

জামালপুর সদর হাসপাতালের তরল মেডিক্যাল অক্সিজেন গ্যাস প্লান্ট। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
বাংলারচিঠিডটকম

২৫০ শয্যার জামালপুর সদর হাসপাতালের তরল মেডিক্যাল অক্সিজেন প্লান্টে বিকট শব্দে গ্যাস নির্গমন বাল্ব খুলে রোগীদের ওয়ার্ডে বাষ্প আকারে শীতল গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় মর্জিনা বেগম (৫৮) নামের একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালের সবগুলো ওয়ার্ডের অন্তত পাঁচ শতাধিক রোগী ও রোগীর স্বজনরা আতঙ্কে ছোটাছুটি করে বাইরে চলে গিয়েছিলেন। তবে দ্রæত সময়ের মধ্যে গ্যাস নির্গমন বাল্ব বন্ধ করায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে হাসপাতালে অবস্থানরত চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রোগীসহ বহু মানুষ। ৯ সেপ্টেম্বর রাতে এ ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ৯ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৮টার দিকে জামালপুর সদর হাসপাতালের নিচতলায় নারী মেডিসিন ওয়ার্ডের পেছন দিক থেকে প্রথমে বিকট শব্দ শুনতে পান রোগী ও রোগীর স্বজনরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘনসাদা ধোঁয়ার মতো শীতল গ্যাসবাষ্প ওই ওয়ার্ডের ল্যাট্রিনের দরজা দিয়ে ভেতরে ছড়িয়ে পড়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এ সময় ওই ওয়ার্ডের অন্তত ৮০ জন রোগীসহ তাদের স্বজনরা ভয়ে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে এবং গুরুতর রোগীদের কোলেকাধে নিয়ে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করেন। এ ঘটনা জানাজানি হলে হাসপাতালের চারতলা ভবনের সবগুলো ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা অন্তত পাঁচ শতাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা প্রাণভয়ে দ্রুত বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে ভবনের বাইরে অবস্থান নেন।

এ সময় নিচতলায় নারী মেডেসিন ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টের রোগী মর্জিনা বেগমের (৫৮) মুখমণ্ডলে অক্সিজেনের মাস্ক লাগানো ছিল। ওয়ার্ডের অন্যান্য রোগীদের দৌড়ে চলে যেতে দেখে অক্সিজেন মাস্ক খুলে তিনিও ওয়ার্ডের বাইরে চলে যাওয়ার পথে স্ট্রোক করেন এবং সেখানেই মারা যান। মৃত ওই রোগী মর্জিনা বেগম জামালপুর পৌরসভার চন্দ্রা গ্রামের মো. জহুরুল হকের স্ত্রী। তবে তার পরিবারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে কোন অভিযোগ না করেই মর্জিনা বেগমের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে গেছেন স্বজনরা।

এদিকে এ ঘটনার খবর পেয়ে জামালপুর সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক চিকিৎসক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান অন্যান্য চিকিৎসকদের সাথে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া রোগীদের ওয়ার্ডে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানালে রোগীরা সবাই যার যার ওয়ার্ডের বিছানায় ফিরে যান।

৯ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে হাসপাতালে গিয়ে ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, রাত পৌনে ৮টার দিকে হাসপাতালের চারতলা মূল ভবনঘেঁষা ও জরুরি বিভাগ সংলগ্ন খোলা স্থানে সম্প্রতি স্থাপিত চার হাজার লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন তরল মেডিক্যাল অক্সিজেন প্লান্টে স্বাভাবিকের চাইতে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এটি এই প্লান্টের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে কখনও কখনও তরল অক্সিজেন গ্যাস নির্গমন বাল্ব খুলে গিয়ে বাষ্প আকারে শীতল গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। বাষ্প আকারে ছড়িয়ে পড়া এই গ্যাস কোনো বদ্ধ কক্ষে জমা হতে থাকলে সেখানে থাকা একজন সুস্থ মানুষও শ্বাসরোধের কারণে গুরুতর অসুস্থ কিংবা মৃত্যুও ঘটতে পারে।

একদিকে মূলভবনঘেঁষা স্থানে স্থাপিত এবং অন্যদিকে এই প্লান্টের দায়িত্বে স্থানীয় প্রশিক্ষিত কোন কর্মী না থাকায় প্লান্টটি গোটা হাসপাতালটিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। ৯ সেপ্টেম্বর রাতের এই গ্যাস প্লান্টের তাপমাত্রা বেড়ে গেলেও তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেখানে কোন প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান না থাকায় অন্তত ২০ মিনিট ধরে তরল গ্যাস বাইরে বেরিয়ে যেতে থাকে। একপর্যায়ে হাসপাতালের স্টোরকিপার শিপলু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে গিয়ে গ্যাস নির্গমন বাল্ব বন্ধ করতে সক্ষম হন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

জামালপুর সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক চিকিৎসক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান এ প্রসঙ্গে এ প্রতিবেদককে বলেন, গ্যাস নির্গমনের ঘটনা জানার পরপরই হাসপাতালের নিচতলার নারী মেডিসিন ওয়ার্ড ও বাইরে অক্সিজেন গ্যাস প্লান্ট পরিদর্শন করেছি। এই প্লান্টের বৈশিষ্ট্যই হলো কোন কারণে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্যাস নির্গমন বাল্ব খুলে যেতে পারে। আজকেও সেই পরিস্থিতির কারণে নির্গমন হওয়া গ্যাস শীতল বাষ্প আকারে নিচতলার নারী মেডিসিন ওয়ার্ডের ল্যাট্রিনের জানালা হয়ে দরজা দিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে বাল্বটি বন্ধ করা হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং আতঙ্কে বাইরে বেরিয়ে পড়া রোগীরা পুনরায় তাদের ওয়ার্ডের বিছানায় ফিরে গেছেন। ওই সময় মেডিসিন ওয়ার্ডে মর্জিনা বেগম নামের একজন রোগীও ভয়ে অক্সিজেন মাস্ক খুলে বাইরে যাওয়ার সময় স্ট্রোক করে মারা গেছেন। তিনি নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন। তবে মৃত ওই নারীর পরিবারের পক্ষ থেকে তারা কোন অভিযোগ করেননি। মারা যাওয়ার পরপরই মরদেহ নিয়ে বাড়িতে চলে গেছেন তার স্বজনরা।

হাসপাতালের ব্যস্ততম মূল চারতলা ভবন ও জরুরি বিভাগ সংলগ্ন স্থানে তরল মেডিক্যাল অক্সিজেন গ্যাস প্লান্ট ঝুঁকিপূর্ণ কিনা-এ প্রসঙ্গে সহকারী পরিচালক চিকিৎসক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, এটি একটি স্পর্শকাতর প্লান্ট। কিন্তু হাসপাতাল কমপ্লেক্সের ভেতরে সুবিধাজনক কোন জায়গা না থাকায় আপাতত সেখানেই গ্যাস প্লান্টটি বসানো হয়েছে।