শেরপুরে মায়া ছড়াচ্ছে ‘মায়াকুঞ্জ’ !

নকলায় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান মায়াকুঞ্জের মনোরম পুকুর ঘাট। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

শেরপুরে মায়া ছড়াচ্ছে মায়াকুঞ্জ। জেলার নকলা উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠেছে এতিম ও দুঃস্থদের সহায়তার জন্য ব্যতিক্রমী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান মায়াকুঞ্জ। এখন ওই স্থানটি ভ্রমণ পিয়াসীদেরও আকৃষ্ট করেছে। ভ্রমণ পিয়াসীরা বলছেন, ঈদ, পূজা এবং পহেলা বৈশাখসহ নানা উৎসবে প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটাতে অনেকেই ভীড় করেন এই স্থানটিতে। তারা এখন মায়াকুঞ্জের মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েছেন। মায়াকুঞ্জের উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারি সহায়তা পাওয়া গেলে এর পরিধি আরও বাড়ানো হবে। অন্যদিকে সরকারি বিধি মেনে আবেদন করা হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা।

মায়াকুঞ্জ ভ্রমণকারিরা জানায়, জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে নকলা উপজেলার প্রত্যন্ত চিথলীয়া গ্রামে স্থানীয় মনসুর আলী এবং পুলিশ বিভাগে কর্মরত তার ছেলে ওসমান গণির পরিকল্পনায় তাদের নিজস্ব ৬০ কাঠা জমিতে গড়ে তোলেন মায়াকুঞ্জ চাইল্ড কেয়ার হোম। বর্তমানে এখানে ২৭ জন এতিমকে বাংলা ও আরবি শিক্ষায় পড়ানোর পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার ব্যয় ভার বহন করছেন তারা। আর ওই চাইল্ড কেয়ার হোমকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল আকারের দীঘি ও পুকুর। সেখানে চাষ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। রয়েছে ডেইরি ফার্ম, ভেড়া-ছাগলসহ হাঁস-মুরগির খামার। এছাড়া দীঘি ও পুকুরের দু’পার জুড়ে রোপণ করা হয়েছে আম, জাম, লিচু, পেয়ারা, মাল্টা, জাম্বুরা নারিকেল গাছসহ হরেক প্রজাতির ফলদ, বনজ, ওষুধি ও ফুলের গাছ। এছাড়া বিভিন্ন মৌসুমে চাষ করা হয় নানা ধরনের সবজি। মাছ ও পশুর খামারের আয় থেকে এতিমদের ভরণপোষণে ব্যয় করা হয়। তারপরও প্রতি মাসে অতিরিক্ত খরচ হলে তা প্রকল্পের মালিক বহন করেন।

ভ্রমণ পিয়াসী আশরাফুজ্জামান বলেন, মায়াকুঞ্জের প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য এবং দীঘির জলে রয়েছে প্যাডেল বোট, আর এর বাইরের দিকের পুকুরগুলোতে রয়েছে সান বাঁধানো ঘাট ও বিভিন্ন বাহারি ফুলের দৃশ্য যা আমাকে মোহিত করে। এখানে ভ্রমণ পিপাসুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে কফি ও টি ঘর। সেখানে পরিবার পরিজন নিয়ে আড্ডায় বসলে কখন যে সন্ধ্যা নেমে আসে তা টেরই পাওয়া যায় না। এভাবেই মায়া ছড়াচ্ছে মায়াকুঞ্জ।

আরেক ভ্রমণ পিয়াসী সজিব খন্দকার বলেন, প্রচন্ড গরমে সবাই যখন হা-হুতাশ করে তখন গ্রামীণ পরিবেশের এ মায়াকুঞ্জের গাছ পালার ঝির ঝির বাতাস মনকে প্রফুল্ল করে তুলে। মনে হবে এখানেই সবুজের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শতশত মানুষ এখানে বেড়াতে আসে। তবে মায়াকুঞ্জের ভিতর কোন ফুল ও ফল গাছে হাত দেওয়া একেবারেই নিষেধ। কারণ এখানে উৎপাদিত বিভিন্ন ফল এতিম শিশুদের জন্য বরাদ্দ।

মায়াকুঞ্জের সত্বাধিকারী মনুসর আলী জানান, প্রায় তিন বছর আগে মায়াকুঞ্জটি বৃদ্ধাশ্রম করার পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করা হয়। প্রতিষ্ঠার প্রায় এক বছর পরও কোন বৃদ্ধ না পেয়ে পরে এটি এতিমখানায় রুপান্তর করা হয়। বর্তমানে এখানে এতিম শিশুদের বিনামূল্যে বই-পুস্তকসহ আরবি ও বাংলা পাড়ানো হচ্ছে। আর তাদের ভরণভোষণের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। প্রথম পর্যায়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস হচ্ছে। এবং পরবর্তীতে এখানে এইচএসসি ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এতিমদের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা রয়েছে তার।

মনসুর আলী আরও জানায়, সরকারি সহায়তা পাওয়া গেলে এর পরিধি আরও বাড়ানো হবে। এখন প্রকল্পের আয় থেকে কিছু খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছে। আর বাকি টাকা নিজ তহবিল থেকে ভর্তুকি দিচ্ছেন।

মায়াকুঞ্জের মূল পরিকল্পনাকারী মনসুর আলীর ছেলে ও পুলিশ বিভাগের ঢাকা স্পেশাল ব্রাঞ্জ (এসবি) শাখার এসআই ওসমান গণি বলেন, মূলত মানুষের সেবা করার উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রকল্পটি প্রায় ৯ বছর আগে শুরু করা হয়। পরবর্তীতে এটি ২০১৫ সালে সমাজসেবার নিবন্ধন পায়। মানবসেবার পাশাপাশি প্রকল্পে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে প্রতিনিয়ত নতুন পরিকল্পনা যুক্ত হচ্ছে। গ্রামীণ পরিবেশে মানুষ একটু প্রশান্তির জন্য এখানে এসে যেনো বেড়াতে পারে সেজন্য এ জায়গাটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এখানে প্রবেশে নেই কোন টিকিট বা প্রবেশ মূল্য।

এছাড়া ইতিমধ্যে এখানে ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য একজন ডাক্তার, একজন স্বাস্থ্য সহকারী, ওষুধপত্র ও মেডিকেল সম্পর্কিত বিভিন্ন সরঞ্জামাদির জন্য বেশ কয়েকটি কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। লক্ষ্য এলাকার অসহায় ও দুঃস্থ মানুষের সহায়তা করা। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে এই মুহূর্তে এটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়নের চিন্তা ভাবনা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে এতিমদের সহায়তায় আর্থিক অনুদান দিতে চান তা সাদরে গ্রহণ করা হবে। এ সময় তিনি সরকারি সহায়তারও দাবি জানান।

সমাজসেবা কর্যালয়ের নকলা উপজেলা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, তিনি মায়াকুঞ্জ পরিদর্শন করেছেন। ওই স্থানটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। এ প্রকল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, যদি উদ্যোক্তারা এতিম শিশুদের জন্য সহায়তা চান তাহলে তা সরকারি বিধি অনুযায়ী করা সম্ভব। তারা আবেদন করলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকল্পে যে পরিমাণ এতিম শিশু থাকবে তারমধ্যে অর্ধেক শিশু প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে পাবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদুর রহমান বলেন, মায়াকুঞ্জে যাওয়া হয়নি এখনো। তবে এ বিষয়ে মানুষের মুখে শুনেছেন। এছাড়া ওই প্রকল্পের ছবি দেখে ভালো লেগেছে। সেখানকার ব্যবস্থাপনা মানসম্মত রাখতে উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।