সরিষাবাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী হেনার মানবেতর জীবন যাপন

উপজেলার ইজারাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান ওরফে চাঁন খাঁর দুই সন্তানের সাথে বিধবা স্ত্রী হেনা বেগম। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

সরিষাবাড়ী (জামালপুর) প্রতিনিধি
বাংলারচিঠিডটকম

‘পাঁচ পুলা-মাইয়া নিয়া খাইয়া না খাইয়া কোনোরহম বাঁইচা আছি। এডা মাইয়া পড়ালেহা করায়েও লাভ অয় নাই। কীয়ের মুক্তিযোদ্ধা কোঠা, তদবির আর টেহা ছাড়া চাকরি দ্যায় ক্যাডা? আরেক মাইয়া অসুখে মরার ভাব, ভালা চিকিস্যাও করাইতে পারি না।’ – চরম ক্ষোভ আর দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে কথাগুলো বলছিলেন একজন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী হেনা বেগম।

জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ইজারাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান ওরফে চাঁন খান। তার মৃত্যুর পর প্রায় ২০ বছর ধরে বিধবা স্ত্রী হেনা বেগম পাঁচজন বেকার ছেলে-মেয়ে ও দুইজন নাতির ঘানি টানছেন। কখনো খেয়ে কখনো না খেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে পরিবারটির। পরিবারের কোনো সন্তানের গতি না হওয়ায় ক্ষোভ এলাকাবাসীরও।

হেনা বেগম জানান, ‘স্বামী জীবিত থাকতে পাটকলে চাকরি করে কোনোরকম তাদের সংসার চলতো। উপার্জনের একমাত্র এই ব্যক্তির ২০০০ সালে মৃত্যু হলে দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে। ধীরে ধীরে ছেলে-মেয়েরাও বড় হতে থাকলে বেড়ে যায় সংসারের খরচ। নামেমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও বড় সংসারের ভার বইতে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে তাঁকে। চারজন মেয়ের মধ্যে তিনজনের বিয়ে হলেও নানা কারণে সংসার বিচ্ছেদে এখন তারাও বৃদ্ধার ঘাড়ে।’

পারিবারিক ও মুক্তিযোদ্ধা সনদ সূত্রে জানা যায়, সরিষাবাড়ী পৌরসভার ইজারাপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুর রহিম খানের ছেলে আব্দুর রহমান ওরফে চাঁন খাঁন ১৯৭১ এ ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রামাণ্য তালিকার ৭৩ নং খণ্ডে ১৮,১৯৯ ক্রমিকে তাঁর নাম অন্তর্ভূক্ত। তাঁর সনদ ক্রমিক নম্বর ২২৮১৮। ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে তিনি একাধিক সম্মূখযুদ্ধসহ বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২০০০ সালের ১ অক্টোবর আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রীসহ চার মেয়ে ও এক ছেলে রেখে যান।

সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান চাঁন খাঁনের স্ত্রী বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে বানানো ভাঙাচোরা ঘরে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করেন। অর্থের অভাবে সব ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করতে না পারলেও চারজনকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন। মেঝোমেয়ে হাসি খানম নিজের অদম্য ইচ্ছায় ডিগ্রি পর্যন্ত পড়েছেন। এলাকায় কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হওয়ায় তিন মেয়ে ও ছেলে রাজধানীতে গার্মেন্টসে চাকরি নেন। এরমধ্যে ছোটমেয়ে বুলবুলি খানম দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় চাকরি ছেড়ে চলে আসেন। হাসি খানম ছাড়া অন্য তিন মেয়ের বিয়ে হলেও তারা স্বামী পরিত্যক্তা। বড়মেয়ে রুমি বেগমের স্বামী শত্রুপক্ষের হাতে খুন হওয়ায় দুই সন্তান নিয়ে মায়ের কাছেই থাকেন। অন্য দুইমেয়ে আর্থিক সমস্যায় তালাকপ্রাপ্তা হয়ে মায়ের ঘাড়ে।

মেঝোমেয়ে হাসি খানম বলেন, ‘আমি শিক্ষিত হয়েও লাভ হয়নি। ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় একটা চাকরির জন্য বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছি, বড়মাপের লোকের সুপারিশ ও তদবির না থাকায় চাকরি হচ্ছে না।’ একটা সুপারিশের জন্য উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের (অধিনায়ক) কাছে গিয়েও পাইনি।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘সরকার অসহায়দের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করেছেন, একটি ঘরের জন্য ইউনিয়ন কমান্ডারের হাতে-পায়ে ধরেও পাইনি। অথচ আমি আওয়ামী লীগের সব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি।’

ছোটমেয়ে বুলবুলি খানম জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমি জটিল রোগে আক্রান্ত। অর্থের অভাবে পুষ্টিকর খাবার ও উন্নত চিকিৎসা নিতে পারছি না। পরিবারে ছোটখাটো একটি চাকরি হলেও আমরা খেয়েপড়ে বাঁচতে পারি। কিন্তু আমাদের দিকে কারো নজর নেই।’

এ ব্যাপারে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক অধিনায়ক মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘পরিবারটি খুব অসহায়। ছেলেমেয়েদের যোগ্যতার অভাবে চাকরি হয়নি। তবে তারা সরকারি ঘর পাওয়ার উপযুক্ত। বিষয়টি আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করবো।’