ঘোষেরপাড়ায় কেজি স্কুলের কাছে মার খাচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

মো. ইমরান মাহমুদ, মেলান্দহ (জামালপুর) সংবাদদাতা
বাংলারচিঠি ডটকম

উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গঠনে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। তবে বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষায় বিদ্যমান বাস্তবতায় রয়েছে ব্যাপক সমস্যা, সংকট ও বৈষম্য। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বনাম কেজি (কিন্ডারগার্টেন) স্কুল। রীতিমতো এক প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতায় কেজি স্কুলের কাছে মার খাচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারি বেশিরভাগ স্কুলগুলোতেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে না বরং কমছে। শিক্ষার্থীদের নতুন গন্তব্য হয়ে উঠেছে কেজি স্কুল। সেই সুযোগে চুটিয়ে ব্যবসা করছে কেজি স্কুলগুলো। এসব কেজি স্কুলে কোনো তদারকি যেমন নেই তেমনি নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষকও। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের অভিভাবকরাও ভরসা করছেন কেজি স্কুলেই। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে এক প্রকার জিম্মিই হয়ে আছেন তারা।

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের অবস্থিত কিছু বিদ্যালয়ে এক সমীক্ষা চালিয়ে মিলেছে এসব তথ্য। প্রাথমিক শিক্ষার মানের পাশাপাশি শিক্ষাব্যয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে।সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্যাচম্যাপ এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশকিছু কেজি স্কুল। যার ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো গরিবের স্কুল নামে খ্যাতি লাভ করতে শুরু করেছে।

মেলান্দহ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নে ১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। আর কিন্ডারগার্টেন রয়েছে ছয়টি।

ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগকে উপেক্ষা করে অভিভাবকরা শিক্ষা বাণিজ্যের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কেজি স্কুলগুলো শিক্ষার্থী ধরতে প্রচারণা চালায়। গাইড বইয়ের ব্যবহারের পাশাপাশি ‘নোট শিট’ প্রদানসহ নানা সুযোগ দেওয়ার নামে কেজি স্কুলগুলো শিক্ষার্থী ধরে। চাকচিক্যই সেখানে মূলকথা।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানের ওপর আজকাল ব্যাপক তদারকি রয়েছে। শিক্ষা প্রশাসন এই ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করায় সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, ভালো ফলাফল নিশ্চিত করতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু ভালো শিক্ষার পাশে চাকচিক্যপূর্ণ পরিবেশ কেজি স্কুলগুলোর বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। অভিভাবকরাও সেদিকেই ঝুঁকছেন।

পশ্চিম ছবিলাপুর গ্রামের হানিফ উদ্দিন তার সন্তানকে ইউনিয়নের একটি কেজি স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি জানান, তার সন্তানের সমবয়সীরা কেজি স্কুলে পড়ে। তাই তার ছেলেকেও সেখানে ভর্তি করেছেন।

আবার আরেক সরকারি স্কুল ছাত্রীর বাবা জানান, সরকারি স্কুলই ভালো, কেজি স্কুলের চেয়ে।

শিক্ষার্থী কমে যাওয়া বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আমরা বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা প্রতি মাসেই নিয়ম করে বাড়ি পরিদর্শনে যাচ্ছি। কোনো শিক্ষার্থী কী করছে, কতটুকু পড়াশুনা করছে সব খোঁজখবর রাখছি। তারপরও কেজি স্কুলের সাথে অঘোষিত প্রতিযোগিতায় থাকতে হচ্ছে।

শিক্ষকরা আরো জানান, শুধু কেজি স্কুল না, প্রাক প্রাথমিক, মসজিদ ভিত্তিক গণশিক্ষা চালু হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ছে না। কেজি স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় পড়ানো হয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমন অভিযোগ থাকলেও সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত মাঠ নেই। কিন্তু স্বল্পপরিসরে খেলার কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। আছে অভিভাবকদের বসার ব্যবস্থাও। শ্রেণিকক্ষ নান্দনিক, দেওয়া হয় রেজাল্ট কার্ড, ডায়েরি ও অভিভাবকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র। এসব ক্ষেত্রেও সরকারি স্কুলগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকটি কেজি স্কুলের পরিচালকের সাথে কথা বলে জানা গেছে,, এখানে ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেখানো হয়। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় নোট শিট দেওয়া হয়। বাসায় হোমওয়ার্ক করতে হয়। সন্তানের মা এখানে দায়িত্ব পালন করেন। বিপরীতে এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানান, তাদের শিক্ষার্থীদের বেলায় স্কুলই শেষ কথা। সরকারি ৮০ ভাগ শিক্ষার্থীই বাড়িতে পড়াশোনা থেকে দূরে থাকে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের অসচেতনতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

কেজি স্কুলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়ার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মজিদ মনে করেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা, মান ও পরিবেশ উন্নত করার ওপর জোর দিতে হবে। বাড়াতে হবে চাকচিক্যও। পাশাপাশি কেজি স্কুলগুলোরও লাগাম টেনে ধরতে হবে। তবেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ভবিষ্যতউজ্জ্বল হবে।