বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষে গণনা চলছে

বাংলারচিঠিডটকম ডেস্ক :

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এখন কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট গণনা চলছে।

সকাল ৮টা থেকে দেশের ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রে একযোগে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিরতিহীনভাবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে।

নওগাঁ-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল ইসলাম মারা যাওয়ায় ওই আসনের নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফলে আজ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়।

এদিকে আচরণবিধি ভঙ্গের কারণে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালি) আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

সচিব জানান, এ পর্যন্ত সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মোট ৭টি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া, প্রিজাইডিং, সহকারি প্রিজাইডিং অফিসারসহ ১৫জন ব্যক্তিকে জাল ভোট প্রদান বা জাল ভোট প্রদানে সহায়তা করার কারণে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ছোটখাটো ৩০-৩৫টি জায়গায় ভোটকেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও পুলিশ অফিসারের গাড়ির গ্লাস ভাংচুর করা হয়েছে। কোথাও ভোটকেন্দ্রের পাশে ককটেল ফোটানো হয়েছে। এছাড়া, এদিকে, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পৃথক এলাকায় নিয়োজিত ২ জন সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার হার্টঅ্যাটাকে মারা গেছেন। এ ঘটনায় কমিশনের পক্ষ থেকে শোক ও দু:খ প্রকাশ করা হয়েছে।

কেন্দ্রভিক্তিক ফলাফল শিটে আগে থেকেই স্বাক্ষর নিয়ে রাখার বিষয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে কমিশন সচিবালয়ের সচিব বলেন, এ রকম ঘটনা ঘটে থাকলে এ বিষয়ে রিটার্নিং বা সহকারি রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ করলে অবশ্যই প্রিজাইডিং অফিসার শাস্তির আওতায় আসবে।

বিভাগ অনুযায়ী তথ্য প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিকেল ৩টা পর্যন্ত ঢাকায় ২৫%, চট্টগ্রামে ২৭%, খুলনায় ৩২%, সিলেটে ২২%, ময়মনসিংহে ২৯%, রাজশাহীতে ২৬%, রংপুরে ২৬% এবং বরিশালে ৩১% ভোট পড়েছে।

সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে ইসি। গতকাল বিকেলের মধ্যে দেশের সকল ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনের সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আর এবার এই প্রথমবারের মতো আজ নির্বাচনের দিন সকাল বেলা ব্যালট পেপার পৌঁছানো হয়েছে।

নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনে এবং ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে অবাধে যাতায়াত করতে পারে সেজন্য মাঠ পর্যায়ে পুলিশ, র‌্যাব, আনসার-ভিডিপি, আর্মি, নেভী, কোস্টগার্ডসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ভোট গ্রহণের কাজে ৮ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকবে। এছাড়াও ১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী স্ট্যান্ডবাই থাকবে। ৩ হাজার ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক মাঠে থাকছে। তারা যেকোন অপরাধে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে পারবেন।

এবার ভোটের সর্বশেষ আপডেট জানার জন্য ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভোটের সর্বশেষ পরিস্থিতির সঠিক তথ্য সম্পর্কে জনগণ যে কোন জায়গা থেকে সহজে জানতে পারবে। এছাড়াও ভোটাররা তার ভোটার নম্বর ও কেন্দ্রের নাম এবং অবস্থান জানতে পারবে। গুগুল প্লে স্টোরে গিয়ে এ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে। ভোটে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ৬৬ জন দায়িত্ব পালন করছেন। এরমধ্যে দুইজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক।

কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি সংসদীয় আসনে ১ হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৫৩৩ জন প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন ৪৩৬ জন।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৬ জন, জাতীয় পার্টির ২৬৫ জন, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৬৬ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচনে নারী প্রার্থী হিসেবে রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৯০ জন। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অন্যান্য মিলে ৭৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

২৯৯ সংসদীয় আসনে মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ২৪টি। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৫৮টি। সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, আজ ২৯৯ আসনে ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৭ জন ভোটার অধিকার প্রয়োগ করবেন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৫ লাখ ৯২ হাজার ১৬৯ জন ও নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার ১৪০। এছাড়া এসব আসনে তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৮ জন।

এবারই প্রথমবারের মতো ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানো হয়। শুধু দুর্গম অঞ্চলের ২ হাজার ৯৬৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো হয় শনিবার।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন স্থানীয় ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক। এছাড়া প্রায় দুই শতাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকছেন। এরমধ্যে ৭৬ জন সাংবাদিক।

নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা দেয়ার জন্য গত ৩ জানুয়ারি থেকে সেনাবাহিনী ৬২টি জেলায় নিয়োজিত হয়েছে। উপকূলীয় দুটি জেলাসহ (ভোলা ও বরগুনা) সর্বমোট ১৯টি উপজেলায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫টি উপজেলায় বিজিবি এককভাবে দায়িত্ব পালন করছে এবং সীমান্তবর্তী ৪৭টি উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সাথে এবং উপকূলীয় ৪টি উপজেলায় কোস্ট গার্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হেলিকপ্টারের সহায়তায় দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্রসমূহে প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান করবে।

এই নির্বাচনে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯১ জন পুলিশ ও র্যা ব সদস্য এই নির্বাচনে আইনশৃংখলা রক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে।

গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে ৪৮৭টি বেজ ক্যাম্পে ১ হাজার ১৫৫ প্লাটুন বিজিবি নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। সারাদেশে নাশকতা এড়াতে বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিজিবি ডগ স্কোয়াড দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে। একইসাথে মাঠে কাজ করছে বিজিবি’র বিশেষায়িত ফোর্স র্যা পিড এ্যাকশন টিম (র্যা ট)। এছাড়া বিজিবি’র কুইক রেসপন্স ফোর্সও প্রস্তুত রয়েছে, যারা বিজিবি’র অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ক্ষমতা রাখে।

নির্বাচনে নিরাপত্তা রক্ষায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৭৮৮ জন সাধারণ আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তারা গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু করেছে এবং ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবে।

এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় মনিটরিং ও কো-অর্ডিনেশন সেল গঠন করেছে। নির্বাচনকালীন সহিংসতায় অগ্নিকান্ডসহ যেকোন ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এ মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২ লাখ ১৫ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ৪ লাখ ৭২ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৭ জনের নিরাপত্তা সদস্যের একটি দল মোতায়েন করা হয়।

নির্বাচন কমিশন জানায়, মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে অস্ত্রধারী দু’জন পুলিশ, অস্ত্রধারী একজন আনসার, অস্ত্র বা লাঠিধারী একজন আনসার, ১০ জন আনসার, লাঠি হাতে একজন বা দু’জন গ্রামপুলিশ সদস্যসহ ১৫ থেকে ১৬ জনের একটি দল সব সাধারণ ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেবে। তবে, প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে অস্ত্রসহ ৩ জন পুলিশসহ ১৬ থেকে ১৭ জনের দল রয়েছে।

নির্বাচন উপলক্ষে ৫ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টা থেকে ৮ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত মোটর সাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে ইসির স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেল এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।

এছাড়া, নির্বাচন উপলক্ষে ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিবসের পূর্ববর্তী মধ্যরাত অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ৭ জানুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত কতিপয় যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এসব যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি ক্যাব, পিক আপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক।