চীনের দ্বিতীয় বিশ্ব ও ইজরাইলের পরাজয়

: রেজাউল করিম রেজা :

লেখাটি মূলত বিগত কয়েকদিনের দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়ার খরব, ডকুমেন্টারি ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে আমার ব্যক্তিক বিশ্লেষণ।

ইজরাইলি বাহিনী কিভাবে পরাজয়ের দিকে যাচ্ছে তা আলোচনার আগে আমাদের দেখা উচিৎ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা সংঘাত, বিভিন্ন পক্ষ ও দেশের প্রতিক্রিয়ায় কি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে যা পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে প্রথমেই দেখতে পাই মুসলিম দেশ ছাড়াও অনেক অমুসলিম সেকুলার দেশগুলোতে অনেক বেশি ইজরাইলবিরোধী আন্দোলন হয়েছে এবং প্রকটভাবে চলেছে অনলাইন মিডিয়া প্রচারণা। ফেসবুক, টুইটার ও ইন্সট্রাগ্রামে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ ও পোস্ট মুছে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও ইজরাইলবিরোধী প্রচারণা চলেছে তুঙ্গে। এই ক্ষেত্রে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে আল জাজিরা, টিআরটি ওয়ার্ল্ড, এ নিউজ, আরব নিউজ, মিডল ইস্ট আই, আনাদলু এজেন্সির মতো তুর্কি ও মধ্যপাচ্যের নিউজ চ্যানেলগুলো। যারা স্ব স্ব মিডিয়াতে ইজরাইলি বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সরাসরি ও ধারণকৃত ভিডিও প্রকাশের পাশাপাশি অনলাইন মিডিয়াগুলোতে ছিল খুবই সরব। এর ফলে ইহুদি মদদপুষ্ট পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান ধারার মিডিয়াগুলো একদিকে তাদের এজেন্ডা মতো প্ররোক্ষভাবে ফিলিস্তিনকে দোষারূপ করে একতরফা খবর প্রকাশ করতে সুবিধা করতে পারেনি। অন্যদিকে সম্মুখিন হয় নানা সমালোচনার। ফিলিস্তিনের পক্ষে জনমত বৃদ্ধিতে কাজ করা এসব সংবাদসংস্থাগুলো এতটায় প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় যে শেষ পর্যন্ত ইজরাইলি বাহিনী এসব মিডিয়ার ফিলিস্তিনি অফিসে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে বাধ্য হয়। যে ঘটনা আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছি।

ইজরাইল কিভাবে পরাজয়ের দিকে যাচ্ছে তা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে ইজরাইলের শক্তির উৎস কে বা কি এবং তাদের দুর্বলতাগুলো কি কি। অতীতে ইজরাইলের শক্তির উৎস যুক্তরাজ্য থাকলেও এখন তা যুক্তরাষ্ট্র। এই যুক্তরাষ্ট্র মূলত তিনটি কারণে ইজরাইলকে সরাসরি মদদ দেয়। প্রথমত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ক্লাসিক ইহুদিদের বংশপরম্পরার একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে এবং তা এতটায় বেশি যে তারা চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত পরিবর্তন করতে পারে। আর যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে চার বিলিয়ন ডলার বা চল্লিশ হাজার লাখ ডলার সামরিক সাহায্য দেওয়ার মতো আর বহু অপ্রকাশিত আর্থিক-অনার্থিক সাহায্য করে থাকে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রযুক্তির জন্য প্রায় পুরোটা নির্ভর করে ইজরাইল কিংবা ইহুদিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। যে আইরন ডোম নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে তা কিন্তু ইজরাইলের নিজস্ব উদ্ভাবন যেখানে অর্থ লগ্নি করেছে যুক্তরাষ্ট্রও। তৃতীয় যে কারণ আর এটাই প্রধানতম কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন তা হলো ইজরাইল হলো মধ্যপাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উড়ে এসে পা ফেলার একমাত্র নিরাপদ ও যথাযথ স্থান। যেখান থেকে সে সমগ্র মধ্যপাচ্যকে অস্থির করে রেখে গডফাদারগিরি করতে পারছে খুব সহজেই।

তাই এটা পরিষ্কার, ইজরাইলকে পরাজয় করার অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে হয় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি হ্রাস অথবা তাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কচ্ছেদ। দ্বিতীয় উপায় তো হবার নয়। তারমানে একমাত্র উপায় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিমত্তা হ্রাস।

হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিমত্তা হ্রাসই হবে ইজরাইলের পরাজয়ের নিয়ামক। অনেকে ভাবতে পারেন এটাও কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। আর সেই ধারা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

প্রথমতঃ অর্থনীতি, সামরিক, প্রযুক্তি ও রাজনীতিতে ইতোমধ্যে চীনের কাছে হারতে বসেছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইন্ডেক্সে চায়নার সামরিক শক্তি বর্তমানে তৃতীয় অবস্থানে তবে নিকট ভবিষ্যতে তা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে। বাহিনীর সৈনিকের সংখ্যায় চীন আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দিগুণ। মহাকাশে নিজস্ব মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে সমুদ্রের নিচ পর্যন্ত তাদের প্রযুক্তির আওতায়। সামরিক বাহিনীতে বাড়ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জামের আধিক্য। প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার পরই চীনের অবস্থান, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান চারে। আবার তাদের আমদানি নির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত।

দ্বিতীয়তঃ অর্থনীতিতেও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। অর্থনীতিতে চীনের শক্তিশালী অবস্থান হলো যুক্তরাষ্ট্রকে ঋণদাতা হিসাবে চীনের অবস্থান দ্বিতীয় যা একটা সময় চীনের জন্য ঘোড়ার লাগাম হিসাবে কাজ করবে। জিডিপিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে বহু আগেই পিছনে রেখেছে। অন্যদিকে চীন পৃথিবীর বহু দেশে স্বল্প লাভে বা লাভহীন প্রজেক্টে দ্বীর্ঘমেয়াদি সম্পদবৃদ্ধি নীতিতে বিনিয়োগ করে চলছে দেদারছে। যার সরাসরি উপকারভোগী হচ্ছে স্বল্প-উন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ।

তৃতীয়তঃ যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে সবচেয়ে বেশি ধরা খাচ্ছে এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে। এক্ষেত্রে চীন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লগিরি রাজনীতির নীতিকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে তাদের এশিয়ান দেশগুলোর অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহজ শর্ত কিংবা শর্তহীন ঋণ ও প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করে। সামনে খেলা মূলত হবে এখানেই। ধীরে ধীরে চীন তার এশিয়ান মিত্রদের সংখ্যা বাড়াচ্ছে এবং ইতোমধ্য চীন রাশিয়া, তুরস্ক, মিসর, সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে ব্যাপকভাবে। এখনো পর্যন্ত চীনের পথের কাটা হিসাবে এশিয়ায় আছে ভারত আর জাপান। অদূর ভবিষ্যতে তারাও নিজেদের প্রয়োজনে বাধ্য হবে নতুন বিশ্বের পরাশক্তি চীনের সাথে বৈরিতা হ্রাস করতে।

সোজা কথা বলতে, চীন দুই বিশ্ব নীতির পথে তাদের কার্যক্রম আগাচ্ছে জোরেসুরে। অর্থাৎ চীন এশিয়াকে এমনভাবে জোটবদ্ধ করবে যা পৃথিবীর বুকে আরেকটা নতুন বিশ্ব হিসাবে দাঁড় করবে। বাকি দেশগুলো থাকবে অপর বিশ্ব ব্লকে। চীন কেন্দ্রিক এই বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষমতার মেরুকরণে পূর্বে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর হতে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এবং দক্ষিণে ভারত মহাসাগর থেকে উত্তরে আর্টিক মহাসাগরের একাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। বাকি বিশ্বের অনেক দেশ তখন এশিয়ামুখি হতে বাধ্য হবে তাদের নিজেদের অর্থনীতির স্বার্থে। চীন এই অঞ্চলে এমন ভাবে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিবে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর মতো কোন অবস্থা থাকবে না। এর প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্র ততদিনে তার দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে চরম বিপাকে পরবে।

এতে ইজরাইলের দম্ভ কিভাবে কমবে? আগেই আলোচনা করা হয়েছে ইজরাইলের শক্তির অন্যতম উৎস হচ্ছে এই যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি দুর্বল হলে তার সামরিক বাজেট কমবে এবং একই সাথে হ্রাস পাবে ইজরাইলকে দেওয়া তাদের নানা সাহায্য। নিজের দেশের সামগ্রিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তারা ইজরাইলকে নিয়ে এতটা মাতামাতি করবে না। আর করলেও তেমন সুবিধা করতে পারবে না। যেহেতু বিশ্ব অর্থনীতি এশিয়া কেন্দ্রিক হবে সেহেতু মধ্যপাচ্যের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শক্ত অবস্থানে যাবে। ততদিনে মধ্যপাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে শক্ত একটি মিত্রতা গড়ে উঠবে আর যার জানান দিচ্ছে তুরস্ক, মিসর, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের বর্তমান বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সুসম্পর্কের উষ্ণতা। সৌদি কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে তার এতদিনের শত্রু দেশ ইরান ও তুরস্কের সাথে মিত্রতা স্থাপন করতে যাচ্ছে। এদের সাথে নিজ থেকে যুক্ত হচ্ছে সিসির মিশর।

মধ্যপাচ্যে যদি এই দেশগুলোর মধ্যে উষ্ণতার সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং চীন এদের মদদ দেয় তবে মধ্যপাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামারিক ঘাটিগুলো একে একে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে এবং উক্ত স্থানে গড়ে উঠবে চীনের সামরিক ঘাটি। স্বাভাবিকভাবেই চাপে পরে যাবে ইজরাইল। তারা চাইলেও আর ফিলিস্তিনিদের ওপর যখন তখন হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারবে না। একই সাথে ফিলিস্তিনের ক্ষমতা পাবে হামাস এবং লেবাননে হিজবুল্লাহ। মিসরে আবার ক্ষমতায় আসবে গণতান্ত্রিক সরকার। ইরাক ও লিবিয়া পুনর্গঠিত হবে। সিরিয়াতে আসবে শক্তিশালী ইসলামি সরকার। আর যা ইজরাইলের জন্য কফিনে শেষ পেরেক গাঁথার কাজ করবে।

অন্যদিকে এশিয়ান এই নতুন বিশ্বে অস্ত্রের বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে চীন, রাশিয়া আর তুরস্ক। প্রযুক্তিতে থাকবে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। গড়ে উঠবে ফেসবুক, টুইটারের মতো শক্তিশালী ও বৃহৎ সোসাল মিডিয়া আর এটা নিয়ে আসবে সম্ভবত তুরস্ক। কারণ তারা ইতোমধ্যে হোয়াটসআপের বিকল্প এপ ‘বিপ’ তৈরি করে সেই দক্ষতা তারা প্রদর্শন করেছে। গুগল ম্যাপের বিকল্প চীন ইতোমধ্যে তৈরি করে রেখেছে। রয়টার্স, এপি, এএফপি, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসির মতো বিশ্ব একচোখা মিডিয়াগুলোর বিকল্প শক্তিশালী মিডিয়া ইতোমধ্যে মধ্যপাচ্য, তুরস্ক ও চিনে অংকুরিত হয়েছে।

এশিয়ান এই বিশ্ব এমনভাবে গড়ে উঠবে যেখানে আমদানি-রপ্তানিতে নিজেরা নিজেদের মধ্যে থাকবে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে তাদের আমদানি নির্ভরশীলতা ব্যাপকহারে কমে রপ্তানি বাড়বে বহুলাংশে। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও দক্ষিণ আমেরিকা হবে এশিয়ান কেন্দ্রিক আমদানি নির্ভর অর্থনীতি।

এশিয়ান ব্লকের বিশ্বে নতুন করে গড়ে উঠবে জাতিসংঘের ন্যায় আন্তর্জাতিক সংস্থা, থাকবে যৌথ সামরিক বাহিনী। মুসলিম দেশগুলোর সংস্থা ওআইসিকে নতুনভাবে সাজানো হবে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব থাকবে তুরস্কের হাতে। এর ফলে ইজরাইল চরমভাবে কোনঠাসা হয়ে পরবে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ে উঠবে গাজা ও পশ্চিম তীর এবং তাদের মধ্যবর্তী ইজরাইলের দখল করা অঞ্চল নিয়ে।

মধ্যপাচ্যের ভূ-রাজনীতি যে নতুন পথে এগুচ্ছে তার বীজ বপিত হয়েছে আর্মেনিয়ার বিপক্ষে আজারবাইজানের নাগর্ন কারাবাখ জয়ী হওয়ার মাধ্যমে।

তবে হতাশাজনক বার্তা হলো দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে বাংলাদেশ-মায়ানমার-ভারত সীমান্তে। আর এক্ষেত্রে মোড়লের ভূমিকা পালন করবে চীন।#

রেজাউল করিম রেজা
ব্যাংকার, ঢাকা

আরও পড়ুন : ইজরাইলের যুদ্ধ বিরতি ও তার পিছনের গল্প