শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সরকার : প্রধানমন্ত্রী

বাংলারচিঠিডটকম ডেস্ক : বিশ্বের কোথাও কোন শিশুর অকাল মৃত্যু তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যে কোন ধরনের শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

তিনি বলেন, ‘শিশুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা সরকার নিচ্ছে। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার-নির্যাতন, কোন কিছু হলে সাথে সাথে যেন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়/হয় সেদিকে আমরা বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, আমাদের শিশুরা নিরাপদ থাকবে, সুন্দরভাবে বাঁচবে এবং মানুষের মত মানুষ হবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ অক্টোবর সকালে ‘বিশ্ব শিশু অধিকার দিবস এবং শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০২০’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে একথা বলেন।

তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত হন।

শেখ হাসিনা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কাল রাতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাঁর ১০ বছরের ছোট ভাই শেখ রাসেল, রাসেলের খেলার সাথী ফুপাতো ভাই ১০ বছরের আরিফ, ফুপাতো ভাইয়ের ৪ বছরের ছেলে সুকান্ত, ১৩ বছরের ফুপাতো বোন এবং তাঁদের বাসার গৃহপরিচারিকার ছেলে ৫/৬ বছরের পটকার নির্মম হত্যাকান্ড স্মরণ করে বলেন, ‘কোন শিশুর অকাল মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। সেটা আমার দেশেই হোক বা অন্য দেশেই হোক।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, এ পৃথিবীটা শিশুদের জন্য নির্ভরযোগ্য, শান্তিপূর্ণ, বাসযোগ্য স্থান হোক। যেখানে প্রতিটি শিশুর একটি ভবিষ্যত গড়ে উঠবে।’

তিনি বলেন, শিশুরাই দেশের ভবিষ্যত, কাজেই সঠিকভাবে তাদের মেধা ও জ্ঞানকে বিকাশের সুযোগ আমাদেরকেই করে দিকে হবে। সেজন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি।

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিব বর্ষ’ উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মের ওপর শিশুদের আঁকা নির্বাচিত ছবি নিয়ে ‘আমরা এঁকেছি ১০০ মুজিব’ এবং নির্বাচিত লেখা নিয়ে ‘আমরা লিখেছি ১০০ মুজিব’সহ শিশুদের লেখা বইয়ের (২৫টি বইয়ের সিরিজ) মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শিশুদের পরিবেশিত বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেছা ইন্দিরা, বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি বীরা মেন্ডোনকা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম।

নাবিদ রহমান তুর্য এবং হৃদিকা নূর সিদ্দিক শিশু একাডেমির শিশুদের পক্ষে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।

করোনাভাইরাসের কারণে একটা সমস্যা এখন দেখা দিয়েছে যে, স্কুল খোলা যাচ্ছে না এবং বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না, সত্যিই সেটা খুব কষ্টের, কারণ ঘরের মধ্যে বসে থেকে কি করবে তারা, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে তবুও কিছু যৌথ পরিবার রয়েছে। যৌথ পরিবারের শিশুদের খুব একটা কষ্ট হয় না, কারণ, নিজের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে সম বয়সী অনেক পাওয়া যায়-তাদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলাধুলা করে, খুনসুটি করে, ঝগড়া করেও আবার একসাথে মিলে খেলাধুলাও করতে পারে। তাদের একটা সুন্দর পরিবেশ থাকে, কথা বলার একটা সুযোগ পায়। কিন্তু যেখানে একক বা ছোট্ট পরিবার বা একা শিশু তাদের জন্য সত্যিই খুব কষ্টকর, তারা কি করবে?

শেখ হাসিনা বলেন, এমন পরিবারের ক্ষেত্রে আমি সমস্ত বাবা-মা বা অভিভাবকদের বলবো যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে তারা স্কুলে যেতে পারছে না তাই আপনারা কাছাকাছি কোন পার্কে নিয়ে যাবেন। সেখানে দিনে অন্তত এক ঘন্টার জন্য হলেও ছোটাছুটি বা খেলাধুলা তারা করতে পারে সে সুযোগটা সৃষ্টি করে দেয়া দরকারি বলে আমি মনে করি। কারণ, তাদের স্বাস্থ্য এবং মানসিক অবস্থার জন্য সবদিক থেকেই এটা খুব দরকার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়ম মেনেই চলতে হবে। পাশাপাশি, বাচ্চাদের একটু খেলাধুলা করা বা খোলা বাতাসে নিয়ে যাওয়া বা রোদে খেলতে দেয়াটা এই করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমি মনে করি। আমি চাই বাবা-মা’রা এই বিষয়টি অন্তত একটু দেখবেন।

এ সময় সারাদেশে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম সৃষ্টির পাশাপাশি করোনাকালিন অনলাইন শ্রেণী কার্যক্রম যাতে হয় সেজন্য তাঁর সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হবার সুবাদে প্রযুক্তি ব্যবহার করেই লেখাপড়া যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে সরকার বিশেষভাবে দৃষ্টি দিচ্ছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, শিশুদের বিকাশে খেলাধুলা, শরীর চর্চা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চা জরুরি, কাজেই সেগুলো যেমন করতে হবে তেমনি মনযোগ দিয়ে লেখাপড়াও করতে হবে। কারণ, শিক্ষা ছাড়া কখনই একটি দেশকে কিছু দেয়া যায় না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৯ মাসের মধ্যে জাতির পিতা আমাদেরকে যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, সেখানেই শিশু অধিকারের কথা বলা আছে। শুধু তাই নয়, একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ তিনি গড়ে তুলছিলেন। চারদিকে অভাব-অনটন অথচ এর মধ্যেও প্রাথমিক শিক্ষাকে তিনি সরকারীকরণ করে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করে দেন।

তিনি বলেন, শিশু বয়স থেকেই আমাদের শিশুরা যাতে লেখাপড়া করতে পারে সে সুযোগ তিনি (বঙ্গবন্ধু) করে দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৪ সালে শিশু অধিকার আইন ও নীতিমালা করে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের মানুষ ২১ বছর অবহেলিত ছিল। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় এসে শিশুদের জন্য প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাসহ জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করে।

তিনি বলেন, জাতির পিতার প্রণীত শিশু আইনের আলোকে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় শিশু শ্রমনীতি ২০১০, জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ এবং শিশু আইন ২০১৩ প্রণয়ন করে শিশুদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।

শেখ হাসিনা বলেন, সারা জীবন মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটানোয় নিজেরা বাবার স্নেহ বঞ্চিত ছিলেন, যদিও শিশুদেরকে জাতির পিতা অত্যন্ত পছন্দ করতেন। যে কারণে ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিনকে সরকার জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।

প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার বক্তৃতার উদ্বুতি দিয়ে বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) সব সময়ই ছাত্রছাত্রীদের বলতেন, ‘লেখাপড়া করো। মানুষ হও। ভালো মানুষ না হলে ভালো দেশ গড়া যাবে না।’

তাঁর সরকার দেশকে পোলিও মুক্ত করায় ব্যাপকভাবে টিকা দান কর্মসূচি এবং শিশু পুষ্টিতে গৃহীত পদক্ষেপের প্রসংগ টেনে প্রধানন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ঝরে পড়া রোধ করতে দেশের বিদ্যালয়গুলোতে স্বপ্রণোদিত হয়ে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে।

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরা যেন সমাজের কাছে অপাংক্তেয় না হয় সেজন্য তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, নানা সুযোগ-সুবিধা এমনকি খেলাধুলাতেও উৎসাহ প্রদান করে যাচ্ছে।

বিশেষ অলিম্পিকে প্রতিবন্ধীদের সাফল্যের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য এ পর্যন্ত তারা ২১টি স্বর্ণসহ ৭১টি পদক জয় করে এনেছে।’

প্রতিবন্ধীদের মেধা বিকাশে সরকার একটি বিশেষ একাডেমী করে দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সমাজের কেউ যেন বাদ না যায় সেজন্য আমরা তাদেরকে বিশেষ ভাতাও প্রদান করছি।’

এ সময় প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার প্রদত্ত ১ কোটি ৩০ লাখ শিশুকে বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান এবং প্রতি মাসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মায়েদের কাছে বৃত্তির টাকা পৌঁছে দেয়ায় পদক্ষেপ প্রসংগে সরকার প্রধান আরো বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও আমরা এই টাকা পাঠানো বন্ধ করিনি। বৃত্তি-উপবৃত্তি আমরা অব্যাহত রেখেছি, যাতে তাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ নষ্ট না হয়ে যায়।’

এপ্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিনা পয়সায় আমরা পাঠ্যপুস্তক যেমন দিচ্ছি, তেমনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য দিচ্ছি ব্রেইল বই। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ও ব্রেইল ভার্সান প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি বলেন, শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের মানসিক বিকাশে সাংস্কৃতিক চর্চা খেলাধুলার জন্য সরকার বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ করে দিচ্ছে।

আজকের শিশুরা যেন মানুষের মত মানুষ হতে পারে সেজন্য মানসম্পন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে তাঁর সরকার বহুমুখি শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। সেই স্বাধীনতার সুফল প্রত্যেকটি মানুষের ঘরে পৌঁছাক। জ্ঞানে বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে বিশ্বসভায় চলবে, সেটাই আমরা চাই।’

তিনি বলেন, ‘আজকের শিশুরা সেভাবেই নিজেদেরকে গড়ে তুলবে। কিছু সমস্যা আসবে। কিন্তু সেগুলোকে মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’ তিনি কবি সুকান্তের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে বলেন-‘এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’সূত্র:বাসস।