স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ । পর্ব-২

|| মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জহিরুল হক বেলাল ||

[মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জহিরুল হক বেলাল। গ্রামের বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার রানাগাছা ইউনিয়নের গোড়ারকান্দা গ্রামে। তিনি সেনা বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের আওতায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে অবদান রাখেন। ‘স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ শিরোনামে লেখাটি মূলত লেখকের আত্মস্মৃতিমূলক যুদ্ধকালীন সেই স্মৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নানা চিন্তাভাবনার মত প্রকাশ করেছেন তার এই লেখায়। বাংলারচিঠিডটকমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে তার এই লেখাটি।]

(পর্ব-২ পড়ার আগে যারা পর্ব-১ পড়েননি এখানে গিয়ে পড়ুন : স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ । পর্ব-১ )

আশুগঞ্জের বিমান হামলা
আশুগঞ্জে আমাদেরকে ভৈরব নদীর পাড় ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে ডিফেন্স নিতে বলা হয়। সেতুর পূর্ব পাড়ে একটি এইচএমজি বসানো হয়। আর আমাকে বলা হয় দক্ষিণ প্রান্তে নদীর পাড় ঘেঁষে এলএমজি নিয়ে অবস্থান করতে। যেন ঢাকা থেকে নদী পথে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আসলে তাদেরকে আটকিয়ে ধ্বংস করতে পারি। কিছু জনসাধারণ এসে আমার এলএমজির বাঙ্কারকে খুব মজবুত করে সেল্টারসহ করে দিল। আশুগঞ্জে সম্ভবত আমরা ২/৩ দিন অবস্থান করি।

তারপর একদিন ভোরে দেখি চারটি জঙ্গি বিমান আমাদের ডিফেন্সের উপর চক্কর লাগিয়ে আমাদের বিভিন্ন বাঙ্কারের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। একমাত্র আমার অবস্থানটাই যুদ্ধবিমানগুলোর দৃষ্টির অগোচরে ছিল। তাই আমি শুরু থেকে ওদের আক্রমণের গতিধারা লক্ষ্য করে আসছি। চারটি যুদ্ধবিমানের প্রবল আক্রমণের মুখে আমাদের ডিফেন্স টিকতে পারল না। সম্ভবত ২০-২৫ মিনিট বা আধা ঘণ্টা যুদ্ধ বিমানের গোলাবর্ষণের পর আমাদের কোম্পানির সৈনিকগণ উইড্রল করতে শুরু করে। হঠাৎ করে একটি যুদ্ধবিমান আমার বাঙ্কারকে লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করে। তখন আমি যুদ্ধবিমানের উদ্দেশ্যে গুলি করতে শুরু করি। আমি একসময় লক্ষ্য করি আমাদের সৈনিকদের গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানগুলোর গুলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়। তখন আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে একা ফেলে রেখে বাকিরা সব চলে গেছে অথবা শহীদ হয়ে গেছে। আমিও চিন্তিত হয়ে পরলাম এবং আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলাম। তখন বুঝতে পারলাম একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যকারী।

যাহোক যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে আমার এলএমজির দ্বারা শর্ট ব্রাশফায়ার মারতে শুরু করলাম। আমি খুব হিসাব করে গুলি খরচ করে যাচ্ছিলাম। এক সময় আমার বাঙ্কারকে লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করার জন্য যেই ড্রাইভ করে ওই মুহূর্তে আমি যুদ্ধবিমানকে লক্ষ্য করে লং ব্রাশফায়ার করি। ওই সময় আল্লাহর অসীম মেহেরবানীতে গোলাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আমার সামনে অদূরে নদীর ভিতরে পরে যায়। আমি শুধু একাই যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি। আর প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতিক্ষায় আল্লাহকে ডাকছি। প্রায় এক ঘণ্টা পর দু’টি ফাইটার চলে গেল এবং দু’টি যুদ্ধবিমানই আমার ডিফেন্স লক্ষ্য করে গুলি নিক্ষেপ করতে থাকল। আমিও ক্ষণে ক্ষণে যুদ্ধবিমানকে লক্ষ্য করে বৃথা গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। যুদ্ধবিমানকে লক্ষ্য করে আমার গুলি ছোঁড়ার কারণে যুদ্ধবিমানটি আমার বাঙ্কারের উপর সঠিকভাবে গুলি নিক্ষেপ করতে পারছিল না। কেননা, আমার চেয়ে ওর মৃত্যুর ভয়টাই ছিল বেশি।

আমি একাই গুলি করছি। আমার একার গুলি করার শব্দ শুনতে পেরে নাসিম সাহেব আমাদের ব্যাটালিয়নের বি কিউএম এইচ ফরাজ আমদে সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে আমার থেকে ৪/৫শ গজ পিছনে গ্রামের ভিতরের একটি গাছ তলায় এসে আমাকে ডাকলেন। আমি নাসিম সাহেবকে ডাকতে দেখে উপরের দিকে ইশারা করে বুঝালাম, আমি বাঙ্কার থেকে উঠতে পারছি না। অগত্যায় ব্যর্থ হয়ে তিনি ফিরে গেলেন। তখন আমার মন আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। বুঝলাম, হয়তো আমার এখানেই মৃত্যু হবে নতুবা বেঁচে থাকলেও আমি আমার কোম্পানি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব।

ভাবছি অনেক কিছু। আমাদের দেশের টাকা দিয়ে যে যুদ্ধ বিমান ও গোলা বারুদ কেনা হয়েছিল সেগুলো দ্বারাই আজ তারা আমাদের হত্যা করে যাচ্ছে। যে যুদ্ধ বিমানগুলো আমাদের রক্ষার জন্য বিদেশ থেকে ক্রয় করা হয়েছিল সেগুলো দ্বারা আমাদেরকে ও দেশের সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে। যুদ্ধ বিমানের বিরুদ্ধে গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে বাঁচানোর জন্য এবং একটি যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করার আশায়। এভাবে সম্ভবত আরও ঘণ্টাখানিক চলল। কিছুক্ষণ পর পালাক্রমে দু’টি যুদ্ধ বিমান ঢাকায় চলে যায় এবং ঢাকা থেকে দুটি যুদ্ধ বিমান এসে গুলি বর্ষণ শুরু করে। আমি হিসাব করে গুলি খরচ করছি। এভাবে প্রায় ৮ বাক্স গুলি শেষ হয়ে যায়। এমন সময় দেখি, যুদ্ধ বিমানের সাথে দু’টি হেলিকপ্টার আসে। যেখানে আমাদের কোম্পানি হেডকোয়ার্টার ছিল সেখানে আমাদের ডিফেন্সের পিছনে ওই হেলিকপ্টার থেকে রশি বেয়ে পাকিস্তানের কমান্ডো সৈনিকরা নামছে। এবং যে রাস্তাটি সম্ভবত সার কারখানার দিকে গিয়েছে ওই রাস্তার উপর কমান্ডোরা এসে অবস্থান নিচ্ছে। এ দেখে আমি বাাঁচার আশা একেবারে ছেড়ে দিলাম। রীতিমতো কালেমা পড়া শুরু করলাম। এবং যুদ্ধ বিমানকে লক্ষ্য করে এলএমজির শর্ট ব্রাশফায়ার দিয়ে যাচ্ছিলাম। আল্লাহর অসীম মেহেরবানিতে একটু পরেই দেখি একটিযুদ্ধ বিমান চলে গেল। অপর যুদ্ধ বিমানটা বারবার চক্কর দিয়ে আমার উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকল। আমি অসহায়ের মত নিষ্ফলভাবে নিজেকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম, আরও দু’টি হেলিকপ্টার আরও কিছু কমান্ডো পূর্বের জায়গায় নামিয়ে দিল। তখন আমার বুঝতে বাকি রইল না, নিশ্চত আমি মারা যাব নতুবা কমান্ডোদের হাতে ধরা পরব।

এদিকে যুদ্ধ বিমানকে গুলি করতে করতে করতে আমার এলএমজির গুলি শেষ হবার পথে। শেষ ম্যাগজিনের চেইনটা এলএমজির সাথে লাগালাম। যুদ্ধবিমানকে লক্ষ্য করে আরও দু’/তিনবার শর্ট ব্রাশফায়ার করে চলে যাবার প্রস্তুতি নিলাম। এলএমজি ও খালি ম্যাগজিনের বাক্সগুলো ব্যাগের ভিতর ভরে কাঁধে ঝুলালাম। আল্লাহর নাম নিয়ে কালেমা পড়তে পড়তে বাঙ্কার থেকে বের হলাম। (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেবকে যে পথ দিয়ে যেতে দেখেছি সে পথ ধরে দৌঁড়াতে শুরু করলাম। তখনও যুদ্ধবিমান আকাশে চক্কর দিচ্ছিল। আমি দৌঁড়ে একটি গ্রামের ভিতর প্রবেশ করি।

আমি সর্বদাই গাছপালার আড়াল রেখে অগ্রসর হতে থাকি। লোকদের জিজ্ঞাসা করি আমাদের সৈনিকগুলো কোথায় গিয়েছে। তারা আমাকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখিয়ে দেয়। আমি তখন সেই বিদ্যালয়ের দিকে যাই। সেখানে যাবার পর (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেবকে দেখতে পাই। তাকে দেখতে পেয়ে আমি অনেকটাই স্বস্তি ফিরে পেলাম। সেখানে ২০/২৫ জন সৈনিক ভাইদেরকে দেখতে পেলাম। বাকি সৈনিকরা কে কোথায় রয়েছে বা কে কে শহিদ হয়েছে এরা কেউ বলতে পারে না।

যাহোক দুপুরে ওখানে খাওয়া-দাওয়ার পর (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেব বিদ্যালয় ঘরে আমাদের বসিয়ে একটি ছোট দরবার নিলেন। তিনি আমাদের উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা খাঁটি মনে বল, আমার সাথে কে কে থাকতে চাও? আর কে কে চলে যেতে চাও ? যারা চলে যেতে চাও তারা আমার নিকট তোমাদের অস্ত্র গোলা জমা দিয়ে চলে যেতে পার। যারা আমার সাথে থাকতে চাও তারা হাত তুল।’ তখন আমরা যে কয়জন সেখানে ছিলাম প্রত্যেকে হাত তুলে স্বীকারোক্তি দিয়ে ওয়াদা করলাম, ‘আমরা মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অথবা দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আপনার সাথেই থাকব।’ আমাদের কথা শুনে (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেব বেশ সন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন, ‘আমরা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য সেনা বিদ্রোহ করেছি। আমাদের ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। গোটা দেশ এবং দেশের জনগণও যদি পাকিস্তানের পক্ষে হয়ে যায় তবুও আমাদেরকে যুদ্ধ চালিয়েই যেতে হবে। ভিয়েতনামের মত আমাদের এ যুদ্ধ আজীবনের যুদ্ধ। তবে একটা কথা মনে রেখ, যদি কোনদিন আমরা দেশ স্বাধীন করতে পারি, তবে সেদিন, তোমাদের একটা বিরাট মর্যাদা হবে। যা তোমরা এখন কল্পনাও করতে পারবে না। আর তোমরাই হবে এ দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক।’

সেদিন এ কথাটা আমার কাছে উপহাসমূলক মনে হয়েছিল। আজও তেমনি মনে হয়। বাস্তবতা বড় কঠিন। তখন আমাদের একটাই স্বপ্ন ছিল, দেশ ও জাতিকে স্বাধীন করা। অতঃপর তিনি আমাদেরকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া গার্ডেনে নিয়ে যান।

তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধ
ক্যাপ্টেন সেলিম সাহেব এবং ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব আমাদেরকে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে যে অবস্থানে নিয়ে যান সেটা ছিল পাক আর্মির সাজানো ফাঁদ। তা নাসিম সাহেব জানতেন না। আমরা যখন ওদের এ্যাম্বুশের ঘেরাওয়ের ভিতর প্রবেশ করি তখন ছিল গভীর রাত। হঠাৎ করে তিনদিক থেকে গুলি শুরু হলো। আমরা উপায় না দেখে পাল্টা গুলি করতে করতে পিছন দিক থেকে বের হয়ে আসি। সারারাত পাকবাহিনীর সাথে গুলাগুলি চলতে থাকে। নাসিম সাহেব আমাদেরকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসেন।

সেলিম সাহেবের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। পরে মাধবপুরে তাকে দেখা যায়। প্রকৃত পক্ষে সেলিম সাহেব ছিলেন পকিস্তানের গুপ্তচর। সেলিম সাহেব আমাদেরকে যতগুলো অপারেশনে নিয়ে গিয়েছিল সবকটি অপারেশনই ছিল আমাদের ধরা পরার মত। কিন্তু মহান আল্লাহর একান্ত ইচ্ছা আমাদেরকে রক্ষা করেছে। আল্লাহ প্রদত্ত নাসিম সাহেবের উপস্থিত বুদ্ধি আর আমাদের অসীম সাহসিকতা প্রতিবারই শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করে তাদের ষড়যন্ত্র তছনছ করে দিয়েছে।

মাধবপুরের যুদ্ধটাও ছিল ক্যাপ্টেন সেলিম সাহেবের চক্রান্ত। সে পাকিস্তানী বাহিনীকে আমাদের ডিফেন্সের পিছন দিক থেকে সরাসরি আক্রমণের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল। এসব কারণে পরে তাকে বন্দী করে হত্যা করা হয়। এ কথাটা আমি পরে শুনেছিলাম। আমি একজন সাধারণ নতুন সৈনিক হওয়ায় উপর থেকে যে সব আদেশ দেওয়া হত সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। প্রকৃতপক্ষে কোথায় কী হচ্ছে তা সরাসরি কিছুই জানতাম না। আমাদের সামনে যা ঘটত শুধু সেটুকুই সরাসরি জানতাম। ... চলবে

স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ । পর্ব-৩