সরিষাফুলের মধু আহরণে স্বাবলম্বী মৌয়ালরা

সরিষাক্ষেতের পাশে মৌয়ালদের রাখা পোষা মৌমাছির বাক্স। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

লিয়াকত হোসাইন লায়ন, ইসলামপুর (জামালপুর) প্রতিনিধি
বাংলারচিঠিডটকম

জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার মাঠে মাঠে এখন নয়নাভিরাম সরিষার হলুদ ফুলের অপরূপ দৃশ্য। পুরো মাঠ যেন ঢেকে আছে অপার সুন্দর এক হলুদ গালিচায়। সরিষাফুলের মধু সংগ্রহে এসব জমির পাশে পোষা মৌমাছির শতশত বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন মৌয়ালরা। বাক্স থেকে হাজার হাজার মৌমাছি উড়ে গিয়ে মধু সংগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে সরিষাফুলের মাঠে। যেন মধু সংগ্রহে পেশাদার মৌয়ালদের মহোৎসব চলছে। এ অপরূপ দৃশ্যে মুগ্ধ হচ্ছে স্থানীয় শিশু-কিশোর থেকে প্রকৃতিপ্রেমী প্রতিটি মানুষ।

সরেজমিনে ইসলামপুর উপজেলার পাথর্শী, গাইবান্ধা, চরপুটিমারী, চরগোয়ালিনী, গোয়ালেরচর ও পলবান্ধা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার বেশির ভাগ ফসলি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এসব জমিতে সরিষার ফুল ফুটতে শুরু করেছে। আর ওইসব ফুলের মধু আহরণে নেমেছেন মৌয়ালরা। মৌয়ালদের বাক্স থেকে দলে দলে উড়ে যাচ্ছে পোষা মৌমাছি। ঘুরে বেড়াচ্ছে এ ফুল থেকে ও ফুলে। সংগ্রহ করছে মধু। মুখভরা মধু নিয়ে এরা ফিরে যাচ্ছে মৌয়ালদের বাক্সে রাখা মৌচাকে।

সেখানে মধু জমা করে ফের ফিরে আসছে সরিষার জমিতে। এভাবে সারাদিন মৌমাছিরা যেমন মধু সংগ্রহ করে, আবার বিভিন্ন ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে পুরো জমির পরাগায়নেও সহায়তা করে। এ মৌসুমে মৌয়ালরা পোষা মৌমাছি দিয়ে প্রচুর মধু উৎপাদন করে যেমন লাভবান হচ্ছেন ঠিক তেমনি মৌমাছির ব্যাপক পরাগায়নে সরিষার বাম্পার ফলন হওয়ায় চাষীরাও লাভবান হচ্ছেন।

ইসলামপুরের পাথর্শী ইউনিয়নের দেলিরপাড় গ্রামে সরিষার ফুল থেকে পোষা মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহে আসা গাজিপুর থেকে আসা পেশাদার মৌয়াল আজিজল হক জানান, তিনি প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও পোষা মৌমাছির ১৫০টি বাক্স নিয়ে সরিষার ফুলের মধু সংগ্রহে ইসলামপুরে এসেছেন। তিনি এবছর প্রতি সপ্তাহে গড়ে আট মণ মধু সংগ্রহ করতে পারেন।

একই উপজেলার পলবান্ধা ইউনিয়নের বাহাদুরপুর এলাকায় সরিষার ফুলের মধু সংগ্রহে আসা মধুপুরের পেশাদার মৌয়াল সোহরাব হোসেন জানান, তিনি একমাস ধরে পোষা মৌমাছির ১২০টি বাক্স নিয়ে সরিষাফুলের মধু সংগ্রহ করছেন।

সরিষাক্ষেতের পাশে মৌয়ালদের রাখা পোষা মৌমাছির বাক্স। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

এখানে সরিষার ফুল থেকে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করে তিনি যেমন লাভবান হচ্ছেন ঠিক তেমনি মৌমাছির ব্যাপক পরাগায়নে সরিষার বাম্পার ফলন হওয়ায় স্থানীয় চাষীরাও লাভবান হচ্ছেন।

মৌয়ালদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দেড় শতাধিক পেশাদার মৌয়াল জামালপুরের সাতটি উপজেলায় সরিষাফুল থেকে মধু সংগ্রহের কাজ করছেন। এসব মধু বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন মৌয়ালরা। আবার মধ্যস্বত্তভোগীরা এ মধু বিদেশ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছেন।

উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন জানান, সরিষা ক্ষেতে মৌবক্স বসালে ফলন ভাল হয়। ইসলামপুর গত বছর শরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে। মৌয়ালরা ১৬ টন মধু উৎপাদন করেছে। এ বছর উপজেলায় ৬ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। এ থেকে ৫ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদন হতে পারে। উপজেলায় মৌয়ালরা মধু সংগ্রহের জন্য প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বক্স বসিয়েছেন। এ অঞ্চলে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও সবচেয়ে বেশি সরিষার আবাদ হয়েছে। সরিষার ফুল থেকে পোষা মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহে লাভবান হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পেশাদার মৌয়ালরা।

তিনি আরও জানান, এক সময় ভোজ্য তেল হিসেবে একমাত্র সরিষার তেল ব্যবহৃত হতো বলে তখন সরিষার প্রচুর আবাদ করা হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সয়াবিন তেলের প্রচলন বেড়ে যাওয়ায় সরিষার আবাদ কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল।

তবে কৃষিবিজ্ঞানীরা সম্প্রতি স্বল্প জীবনকালের ধান ও স্বল্প জীবনকালের উচ্চ ফলনশীল সরিষাসহ বিভিন্ন জাতের ফসল উদ্ভাবন করেছেন। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লাভজনক শস্যবিন্যাস পদ্ধতিতে একই জমিতে বছরে অধিকবার ফসল ফলানোর ক্ষেত্রে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এতে এখন বহু জমিতে বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষার আবাদ হচ্ছে এবং সরিষার আবাদকে ঘিরে পোষা মৌমাছি দিয়ে মধু আহরণের মাত্রাও বেড়ে গেছে।