শেরপুর- ২ আসনে দ্বন্দ্বেই আটকে আছে মতিয়া-বাদশা

সুজন সেন
নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠি ডটকম

বদিউজ্জামান বাদশা আওয়ামী লীগের কেউ না, ওর বাবা রাজাকার ছিল। তাই তাকে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। এমনই দাবি করা হয়েছে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। এক সময়ের কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এই নেতাকে মাইনাস করেই চলছে শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী) আসনের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। রাজনৈতিক মহলের মতে, দীর্ঘ ২২ বছর ধরে চলা মতিয়া-বাদশার দ্বন্দ্ব আর এখানকার আওয়ামী লীগের এই বিভেদ ও বিভক্তির রাজনীতির লাগাম এখনই টেনে ধরা না হলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সূত্র জানায়, রাজনৈতিক জীবনে বাদশা কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি ও নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তিনি শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য। এ ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী) আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। বাদশা একজন কৃষিবিদ। তার বাবার নাম আব্দুল কুদ্দুস। বাড়ি উপজেলার ছিটপাড়া আমবাগান এলাকায়।

এ আসনে এবার পঞ্চমবারের মত দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে লড়ছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। মতিয়ার এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন বাদশা। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় পর্যায়ের দুইজন ছাত্রলীগ নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ঠিক এরপর থেকেই মতিয়া চৌধুরীর সাথে বাদশার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সে দূরত্ব আজও ঘোচেনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয় এই দুই নেতার বিরোধের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভক্তির ধারাবাহিকতা আরো প্রকট হয়। যা প্রকাশ্যে আসে এবারের নির্বাচনে। যেমন মতিয়ার কোন নির্বাচনী প্রচারণায় আগ বাড়িয়ে যেতে দেখা যায়নি বাদশা ও তার বলয়ের নেতাকর্মীদের। অন্যদিকে মতিয়ার পক্ষ থেকেও বাদশাকে অংশ গ্রহণ করতে বলা হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ থাকায় নৌকার পক্ষেই প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন এমনটাই দাবি করেন বদিউজ্জামান বাদশা।

সূত্র জানায়, বাদশা এলাকার সন্তান এই দাবি তুলে তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপের কারণে পিছপা হন। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বেগম মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেলেও প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে হয় নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী বদিউজ্জামান বাদশার সাথে।

এক প্রশ্নের জবাবে নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক বলেন, বদিউজ্জামান বাদশা উপজেলা আওয়ামী লীগের কেউ না, তাই তাকে নির্বাচনী প্রচারণায় নেয়া হয়নি। আর ওর (বাদশা) বাবা তো ৭১’ এ রাজাকার ছিল। তালিকা অনুযায়ী তার বাবার নাম ২৬ নাম্বারে রয়েছে। এ ছাড়া ওর শ্বশুর ৬১ আর চাচা শ্বশুর ৬২ নাম্বারে তালিকাভুক্ত রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বদিউজ্জামান বাদশা বলেন, পাকিস্তান আমলে আমার বাবা আব্দুল কুদ্দুস নালিতাবাড়ীর যোগানীয়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন। আর ২৬ নাম্বারে তালিকাভুক্ত আব্দুল কুদ্দুসের বাড়ি মরিচপুরান ইউনিয়নে। এ থেকে প্রমাণিত হয় আমার বাবা রাজাকার ছিলেন না। এ ছাড়া তার শ্বশুরের নাম রাজাকারের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হওয়ায় তার শ্যালক এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। অন্যদিকে তার চাচা শ্বশুর সাইদুল মৌলানা কুখ্যাত রাজাকার ছিলেন বলে জানান তিনি। বাদশা জানান, তার বাবার বিষয়ে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মতিয়া চৌধুরীর আবিস্কার। কোন জায়গায় ঠেকাতে না পেরে দেড় দুই বছর আগে থেকে তার (বাদশা) বিরুদ্ধে এ অপপ্রচার চালানো হয়। জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের সময়ও মতিয়া তার (বাদশা) নাম দেখে বিরুদ্ধাচ্চারণ করেন। কিন্তু নেত্রী (শেখ হাসিনা) এতে মনক্ষুন্ন হন। বাদশা বলেন, নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হকের বাবা রাজাকারের সহযোগি ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এলাকায় পুল পাহাড়া দিতেন।

বাদশা আরো বলেন, আমি এবার প্রার্থী হইনি শুধুমাত্র নেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের কারণে। ওরা এই সমস্ত কথা বলে জন্য আমার লোকজন মন খারাপ করে। দলের জন্য কাজ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

মতিয়া চৌধুরীর আপন ভাই মেজর (অব:) শহীদুল হক চৌধুরীর কথা টেনে এনে বাদশা বলেন, তিনি (শহীদুল) মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫৭ বিগ্রেডে কুমিল্লায় চাকরিরত ছিল। তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেননি। পাক বাহিনীর সাথে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। পরে দেশ স্বাধীনের কিছু সময় পরেই তিনি পাকিস্তান চলে যান। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে পাকিস্তান থেকে যে সমস্ত অফিসারদের ফেরত আনে তাদের মধ্যে শহীদুল হক চৌধুরী ছিলেন। পরে তাকে পুলিশে চাকরি দেওয়া হয়। প্রমোশন পেয়ে তিনি এডিশনাল ডিআইজি হন। এরপর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে দশ জন কুখ্যাত পাকিস্থানী যুদ্ধাপরাধীকে চাকরিচ্যুত করে শহীদুল তাদের একজন। মতিয়া চৌধুরী তাদেরকে এখনও সাহায্য করেন এমন দাবি করে বাদশা বলেন, এর মধ্যে তার ভাতিজা বরিশাল বিএল কলেজের ছাত্রদলের সাবেক নেতা মুরাদকে প্রমোশন পাইয়ে দেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে কথা বলে।

নৌকার বিজয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বাদশা বলেন, নকলা-নালিতাবাড়ী আসনে মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তিনদফা সাক্ষাত করেছি। তিনি যেভাবে আমাকে নিদের্শনা দিয়েছেন আমি এলাকায় সেভাবে কাজ করে যাচ্ছি। মতিয়া চৌধুরী আমাকে নির্বাচনী প্রচারে না ডাকলেও নৌকা প্রতীকের বিজয়ের স্বার্থে এলাকায় সভা সমাবেশ করছি। ইতোমধ্যে নয়াবিল ও গাজীরখামারে সভা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিনিয়ত ঘরোয়া বৈঠকের মাধ্যমে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বোঝানো হচ্ছে নৌকার ভোট নষ্ট করা যাবেনা। মতিয়া চৌধুরীর সাথে আমাদের বিরোধ থাকলেও নৌকাকে বিজয়ী করতে আমরা একজোট হয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এ ছাড়া দলের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের পরামর্শে নৌকার বিজয়ের লক্ষে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটেও সভা সমাবেশ করছি।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান, রতন, কাইয়ূম, জাহাঙ্গীর ও সাফায়াত বলেন, নকলা-নালিতাবাড়ী দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে আওয়ামী লীগে ঐক্য নেই প্রায় ২২ বছর ধরে। বিশেষ করে নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগে আছে বিভেদ ও পরস্পরকে কোণঠাসা করার রাজনীতি। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে বেড়েছে দূরত্ব ও হতাশা। এলাকার এমপি ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বদিউজ্জামান বাদশা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম উকিল এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকসেদুর রহমান লেবুর মধ্যকার অদৃশ্য টানাপড়েনে এখানকার আওয়ামী লীগ বহুধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর বিভক্তির পুরো সুবিধা কাজে লাগিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যানের পদটি ছিনিয়ে নেয় বিএনপি। একই কারণে বিগত পৌর মেয়রের পদটিও ছিল বিএনপির দখলে। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে চলা এখানকার আওয়ামী লীগের এই বিভেদ ও বিভক্তির রাজনীতির লাগাম এখনই টেনে ধরা না হলে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিভক্তি ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ের এমপি ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর সুনজরে থাকা তৎকালীন কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ নেতা বদিউজ্জামান বাদশা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হালিম উকিলের দ্বন্দ্বের বলি হন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ চকন ও সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়ে। ওই নির্বাচনে সামান্য ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে চারদলীয় জোট প্রার্থী বিএনপির জাহেদ আলী চৌধুরীর কাছে পরাজিত হতে হয়। পরে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বেগম মতিয়া চৌধুরী পুনরায় বিজয়ী হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বেগম মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেলেও প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে হয় নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী বদিউজ্জামান বাদশার সাথে। তবে নির্বাচনের দিন ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে বেলা ১১টায় বাদশা নির্বাচন বর্জন করেন। বেগম মতিয়া চৌধুরী চতুর্থবারের মতো এলাকার এমপি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৯৬ সাল থেকে যে বিভেদ আর বিভক্তির রাজনীতি শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। বর্তমানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভক্তির ধারাবাহিকতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে।