সংবাদপত্র সভ্যতার অংশবিশেষ। বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে জামালপুরের নামটি বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়ে থাকে। কারণ, জামালপুর থেকে বিশ শতকের পঞ্চাশ দশকে ‘সাপ্তাহিক তওফিক’ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটিতে আনজুমান আরা জামান, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, গোলাম মোহাম্মদ, আলী আছাদ, সি এম সফিছামি (তখন ৭ম শ্রেণিতে পড়ত, পরবর্তী কালে পররাষ্ট্র সচিব), মো. শামসুল হুদা প্রমুখ লিখতেন। সংবাদপত্র পাঠ না করলে কারও জ্ঞান ও শিক্ষা পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে না। সুতরাং জাতীয় জীবনে সংবাদপত্রের শিক্ষা অপরিসীম। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সমাজসেবা ও সমাজ সংস্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের দান অতুলনীয়। এটি সরকারের সঙ্গে জনগণের সংযোগ সাধন করে।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের (১৯০৫-১৯৮৫) সম্পাদনা ও প্রকাশনায় তার আমেনা প্রেসে মুদ্রিত ‘সাপ্তাহিক তওফিক’ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই জামালপুর মহকুমার বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জাগরণের কালে তাদের মেধা, মনন, শিল্প, সাহিত্য ও রাজনীতির বিকাশে ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের কয়েক বছর পরে ১৯৫০ সালে জামালপুর থেকে প্রকাশিত হয়। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার তওফিক পত্রিকার একাধারে সম্পাদক, মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন। তিনি অবিভক্ত জামালপুর মহকুমায় মির্জা সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন।
তওফিক পত্রিকাটি সপ্তাহে একবার প্রকাশিত হতো। আমরা জামালপুর শহরের মিঞা বাড়ির বাসিন্দা সৈয়দ সাকিবুদ্দীনের নিকট থেকে তওফিকের যে কয়টি সংখ্যা সংগ্রহ করেছি তন্মধ্যে ষষ্ঠ বর্ষের ১৮০তম সংখ্যার প্রকাশ কাল ২১শে মার্চ ১৯৫৫, মূল্য ১ আনা ছয় পয়সা।
তওফিক ছিল সমকালের অন্যান্য পত্রিকা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের। ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ ক্রমেই যখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মোহ ভাঙল তখন এই পত্রিকা ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৫’র আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে তৎকালীন সরকার এই পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল করে। এই প্রসঙ্গে আলোচ্য পত্রিকার মেক-আপ সম্পর্কে কিছু কথা বর্ণনা করা প্রণিধানযোগ্য।
উল্লেখ্য, তওফিকের কভার পেজের প্রতিটি সংখ্যার বাম দিকের শিরোদেশে কুরআনের সূরা আত-ত্বিনের ৪ নং আয়াত ‘নিশ্চয়ই মানুষ সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সম্মানিত জীব’ এই কথা মুদ্রিত থাকত। এই বাণীর নিচে থাকত’ তওফিক জামালপুরের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ডালা বহন করে’ এবং ডান দিকের শিরোদেশে থাকতো পবিত্র কুরআনের সুরা আল-আহযাবের ২১ নং আয়াত ‘নিশ্চয়ই রছুলল্লাহ তোমাদের শ্রেষ্ঠ আদর্শ’।
ঠিক এই বাণীর নিচে মুদ্রিত থাকত ‘তওফিক জামালপুরবাসীর অভাব অভিযোগের দাবি পেশ করে’। তওফিক-এর প্রতিটি সংখ্যার কাঠের হ্যান্ডসেটে সাপ্তাহিক তওফিক ইংরেজিতে THE WEEKLY TOWFIQ ও তার নিচে ‘জামালপুর পাবলিকের মুখপত্র’ কথাটি মুদ্রিত থাকত এবং এটির নিচে সম্পাদক হিসেবে মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের স্বাক্ষর মুদ্রিত হতে দেখা যায়। তওফিকের সবার উপরে সমকালের তদানীন্তন নিখিল পাকিস্তানের চাঁদ তারা পতাকার ছবি মুদ্রিত হতে দেখা যায়। তওফিক-এর রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ডিএ ১৩৯।
আলোচ্য পত্রিকাটি সম্পর্কে জামালপুরের বিদ্বৎসমাজের আগ্রহ ও অনুরোধে সংগৃহীত এ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যার প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ, ফিচার প্রভৃতি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হলো।
১ম কিস্তি
এই সংবাদের কম্পিউটারে টাইপকৃত পাঠোদ্ধার নিম্নরূপ :
পূর্ব্ববঙ্গে পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থা আরও কয়েক দিনের জন্য স্থগিত।
প্রধান মন্ত্রীর সদলবলে করাচী প্রত্যাবর্ত্তণ বর্ত্তমান মাসের শেষের দিকে পার্লামেন্টার শাসন ব্যবস্থার কায়েম হইবার আভাষ দান।
প্রধান মন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী রাষ্ট্র সচিব জেনারেল ইসকান্দর মীর্জা, স্বাস্থ্য সচিব জনাব আবু হোসেন সরকার সহ বিগত ৫ দিন ঢাকায় অবস্থাণ করিয়া করাচী ফিরিয়া গেলেন।
তিনি সকল মহলের সহিত বর্ত্তমান পরিস্থিতি আলাপ আলোচনা করেন এবং তাঁহার আগমন আংশিক ভাবে সফল হইয়াছে বলেন। এই মাসের শেষের দিকে তিনি পুনরায় ঢাকায় আসিবেন এবং পার্লামেন্টারী শাসন প্রবর্ত্তনের ব্যবস্থা নাকি করিবেন বলিয়া প্রকাশ। পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থা আরও কয়েকদিনের জন্য স্থগিত হওয়ায় সকলের দৃষ্টি এখন করাচীর দিকে সিমাবদ্ধ রহিল।