দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত

মেসবাহুল হক :

নতুন সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। সরকার গঠনের পর প্রথমেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি জানতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেছিলেন। এর আগে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বর্তমান সরকারের প্রথম সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচিবদের নির্দেশ দেন।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপনের জন্য একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব পরিকল্পনার মূলে রয়েছে– দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে পণ্যের সরবরাহ ও মনিটরিং বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সহজীকরণ এবং ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এক নম্বরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। এটি নিশ্চিতে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই কাজ শুরু করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ভবিষ্যতে এসব বিষয়ে আরও পরিকল্পিতভাবে কাজ করা হবে।

দায়িত্ব নেওয়ার পরই বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, উৎপাদক, আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। তিনি নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন হলে যথাসময়ে আমদানি করে হলেও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার ওপর জোর দিচ্ছেন। কারণ, চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ঘাটতি না থাকলে বাড়তি সুযোগ নিতে পারবেন না ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যদি কোনো পণ্যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, তাদের কঠোর হাতে দমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অভিযোগ পাওয়া মাত্র তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আসন্ন রমজানকেন্দ্রিক বাজার নিয়ন্ত্রণ ও পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ও প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রম আরও বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিগগির ভোজ্যতেল ও চিনি রিফাইনারি বড় কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি বড় বাজারগুলো পরিদর্শন ও সেখানকার বাজার কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। কোথায় কী ধরনের সমস্যা রয়েছে, তা জানার চেষ্টা করা হবে।

তারা জানান, দীর্ঘমেয়াদে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর আইন দ্রুত সংশোধন ও জনবল বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতা কমিশনেও আরও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এদিকে চালের বাজারে কারসাজিতে জড়িতদের ধরতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চালের বিভিন্ন বেঞ্চমার্ক দাম নির্ধারণের বিষয়ে একমত হয়েছে বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়। এটি চূড়ান্ত হলে মানভেদে বিভিন্ন চালের বস্তায় বেঞ্চমার্ক দাম হিসেবে পাইকারি পর্যায়ে ট্রেডিং প্রাইস এবং খুচরা পর্যায়ের জন্য সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। কোনো ব্যবসায়ী নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করলে বা কারসাজি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। বর্তমানে চালের বেঞ্চমার্ক দাম নির্ধারিত না থাকায় কোনো ব্যবসায়ী দাম বাড়ালেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

প্রায় দুই বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে থাকা ডলার সংকটে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে এলসি খুলতে সমস্যার কথা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করে এ ক্ষেত্রে ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানান। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের আরও একটি কারণ হচ্ছে– বাড়তি শুল্ক-কর। তাই সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরে শুল্ক-কর কমানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ বিশেষ করে রপ্তানি বাড়িয়ে চলমান ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রপ্তানি বহুমুখী করতে পোশাক খাতকে যে সুবিধা দেওয়া হয়, অন্য খাতকেও যদি একই সুবিধা দেওয়া হবে। তা ছাড়া আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে। তখন বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া যাবে না। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ২০২৬ সালের মধ্যেই বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল ও মহাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার চেষ্টা করছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রতিবেশী ভুটানের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) সই হয়েছে। জাপানের সঙ্গে এফটিএর আদলেই অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ) করার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশটির সঙ্গে এফটিএ করতে চায় সরকার। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রস্তাবিত কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) চুক্তিও দ্রুত শেষ করতে চায় সরকার। চীন, সিঙ্গাপুরসহ অন্তত ১০টি দেশের সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করা হবে।