শেরপুরের গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে সরকারের নানা উদ্যোগ

ক্ষুদ্ধ হাতির দল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে হানা দেয়। ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর, বাংলারচিঠিডটকম: সীমান্ত ঘেঁষা শেরপুরের তিনটি উপজেলার ৪০টি গ্রাম বনাঞ্চল ঘেরা। ওইসব পাহাড়ি এলাকায় ভারত থেকে নেমে আসা শতাধিক বন্যহাতি দল বেঁধে দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করে আসছে। তাই সরকার বন্যহাতি সুরক্ষায় সেখানে অভয়ারণ্য তৈরি করে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বনাঞ্চলের ভূমি স্থানীয়রা দখলে নেয়ায় সংকুচিত হতে থাকে বনের পরিসর। এতে ক্ষুদ্ধ হাতির দল খাবারের সন্ধানে পালাক্রমে এখন লোকালয়ে হানা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। এ কারণে পাহাড়ি অঞ্চলে এখন হাতি আতঙ্ক বিরাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, জীবিকার আর অন্য কোনো উপায় না থাকায় বনের জমিতে তারা চাষাবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে হাতি মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে ২৩টি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম আবারও সক্রিয় করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা বন বিভাগ।

জেলা বন অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলা বনাঞ্চল এলাকা। সেখানকার লোকজন ধীরে ধীরে চলে গেছে বন্যহাতির আবাসস্থলে। যেখানে হাতির থাকার কথা সেখানে এখন মানুষ রাজত্ব করছে। এ জন্য হাতি আর মানুষের দ্ব›দ্ব এখন প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব নিরসনে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বন বিভাগসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল হাতি সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা করতে ভারতের বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। একই কারণে ভারতের কর্মকর্তারাও এদেশে এসেছেন। কিন্তু লোকবলের অভাবে সেই অভিজ্ঞতা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

তারা জানান, হাতির অভয়ারণ্য এলাকায় মানুষজন বনের ভিতরে বাড়ি-ঘর তৈরি করছে। বনের গাছপালা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে জঙ্গল পরিষ্কার করে জবরদখল করে মৌসুমভিত্তিক ফলমূল ও সবজি আবাদ করছে। এতে বন্যহাতির আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে আসছে। এ কারণে ক্ষুদ্ধ হাতির দল লোকালয়ে এসে বারবার মানুষের বাড়ি ঘরে হানা দিচ্ছে। এবং চলতি আমন ধানের পাকা ফসল খেয়ে সাবার করে দিয়েছে। বাদ যাচ্ছে না ফল বাগান আর সবজি ক্ষেত।

তারা আরও জানান, স্থানীয় জনসাধারণের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২০১৬ সালে লোকালয়ে হাতির হামলা ঠেকাতে ঝিনাইগাতী উপজেলার তাওয়াকুচা এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সোলার ফ্যান্সিংয়ের (বৈদ্যুতিক বেড়া) পাইলট প্রকল্প (পরীক্ষামূলক) বাস্তবায়ন করে। কিন্তু এসব এলাকার মানুষ বনের ভিতর গরু চড়িয়ে সোলার ফ্যান্সিংগুলো ধ্বংস করে ফেলে।

ওই কর্মকর্তারা বলেন, এলাকাবাসীর জানমাল ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা মাথায় রেখে আবারও নতুন করে শ্রীবরদীর রাঙ্গাজান, খ্রিস্টানপাড়া ও বালিজুড়ি এলাকার আট কিলোমিটার জুড়ে সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নষ্ট হয়ে যাওয়া সোলার ফ্যান্সিংগুলো মেরামতের জন্য বাজেট চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়া হাতিকে বনে রাখার জন্য সরকারের সুফল প্রকল্পের আওতায় বিপুল পরিমাণ ওষুধি, ফলমূল ও কাঠগাছ রোপণ করা হচ্ছে। এখন জনসাধারণকে বনের জ্বালানি কাঠ ও আগাছা কাটতে দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে ওই এলাকা আরও গহীণ বনে পরিণত হবে। সেখানে থাকবে ফুড ফেস্টার বাগান (তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ), বাঁশ, কলা, কাঁশফুলের বাগান, আমলকি, হরতকি, বহেড়া ও চাপালি জাতীয় গাছ। এক সময় বনে আর হাতির খাবারের অভাব হবে না। পাশাপাশি হাতির খাবারের সংস্থান আরও স্থায়ীরূপ দিতে চিন্তাভাবনা চলছে।

স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে, ১৯৯৫ সাল থেকে বন্যহাতির আক্রমণে এ পর্যন্ত জেলার ওই তিন উপজেলার নারী, পুরুষ ও শিশুসহ প্রায় শতাধিক মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছেন প্রায় আড়াই শতাধিক ব্যক্তি। অন্যদিকে নানা কারণে অন্তত ৬০টি বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত বন্যহাতির আক্রমণে শতশত ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সহাস্রাধিক একর জমির ফসল, সবজি ক্ষেত ও ফল বাগান নষ্ট হয়েছে। হাতির তান্ডবে অনেক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষী পরিবার বেকার ও দিন মজুর হয়ে পড়েছে।

নালিতাবাড়ী সীমান্তের বুরুঙ্গা কালাপানি এলাকার কৃষক এন্ডারসন সাংমা ও লুইস নেংমিজা জানান, শেরপুরের তিন উপজেলার ৪০টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের জীবন কাটে হাতি আতঙ্কে। আগে মশাল জ্বালিয়ে, হৈ-হুল্লোড় করে হাতি তাড়ানো যেতো। এখন হাতি কোনটাই পরোয়া করে না। উল্টো মানুষকেই ধাওয়া করে হাতি।

তারা আরও জানান, পাহাড়ে হাতিগুলো খাদ্য ও পানীয় জলের চরম সঙ্কটে পড়েছে। তাই তৃষ্ণা মেটাতে হাতিগুলো পাহাড়ি জলাশয় কিংবা নদীতে নেমে পড়ছে।

ঝিনাইগাতীর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হক বলেন, সরকার সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা লোকবল নিয়োগ করলে ভালো হতো।

জেলা এলিফ্যান্ট রেসস্পন্স টিমের সভাপতি উকিল উদ্দিন বলেন, সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলিতে আমাদের দুই শতাধিক সদস্য রয়েছে। লোকালয়ে হাতির আক্রমণ ঠেকাতে তারা নানা ধরনের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এছাড়া মাইকিং করে এলাকাবাসীকে সচেতন করছেন এবং সহযোগীতা করে যাচ্ছেন।

অন্যদিকে হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নালিতাবাড়ীর ইউএনও খ্রিষ্টফার হিমেল রিসিল।

মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, হাতিগুলোকে কেউ যাতে বিরক্ত না করে, সে বিষয়ে আমরা স্থানীয়দের সচেতন করে যাচ্ছি।

জেলা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুমন সরকার জানান, হাতি মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে ২৩টি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম আবারও সক্রিয় করা হচ্ছে। পাশাপাশি হাতির অভয়াশ্রম তৈরি করতে নতুন একটি প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।