দারিদ্র জয়ের যুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মীরচরের স্বপ্নবাজ রহিমা বেগম

ক্রমশ আত্মনির্ভশীল হয়ে ওঠা রহিমা বেগম।ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

জাহাঙ্গীর সেলিম:
কুড়েঁঘরটি ভেঙে টিনের দোচালা ওঠেছে। দিন বদলের সাথে সাথে জীবন ও সংসার পাল্টে দেওয়ার সংগ্রামে ক্রমশই সফলতার মুখ দেখতে পাচ্ছে রহিমা বেগম। দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করে জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মীরচরের লড়াকু নারী রহিমা। একদিন ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা শিখে মানুষ হবে। নতুন বাড়ি হবে। সুখের পায়রা উড়ে বেড়াবে তার আঙ্গিনা জুড়ে এসব স্বপ্ন দেখেন তিনি। স্বপ্নপূরণে দিনরাত কাজ করছেন রহিমা বেগম।

জামালপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীরচর ইউনিয়নের ভারুয়ামারী গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর আশরাফুলের স্ত্রী রহিমা বেগম। ২ মেয়ে ১ ছেলের জননী রহিমা বেগম স্বামীর স্বল্প আয়ে সংসার পরিচালনা করতে কুলিয়ে ওঠতে পারছিলো না। সন্তানদের নিয়ে পুষ্টিকর খাবারতো দূরের কথা দুবেলা ভাত জুটানোই কঠিন ছিলো তার। প্রতিবছর বন্যা, নানা ধরনের অসুস্থতায় দিশেহার হয়ে পড়ে রহিমা ও তার স্বামী। নিরক্ষরতা এবং সুস্থধারায় চিন্তা বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার করার কোন শক্তি তাদের ছিলো না। বাড়িভিটার ছয় শতাংশ জমিই তাদের একমাত্র সম্বল। সে জমি আবার বালুময়।

এ এলাকার সামাজিক, অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কথা বিবেচনা করে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ নেয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানবিক ও শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্যতম বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন সংঘের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রাম (এপি) এর কাজ শুরু করা হয়। এর মাধ্যমে প্রথমেই জরিপের কাজ শেষ করে। সামাজিক মানচিত্র তৈরি করে এলাকার সবধরনের তথ্য ওঠে আসে সংস্থার হাতে।

রহিমা বেগমের বাড়ির আঙ্গিনায় শাক, সবজি ক্ষেত।ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্যান্য এলাকার মতো চরভূমি অধ্যুষিত ভারুয়ামারী গ্রামেও এলাকাবাসীর ইচ্ছে মতে গঠন করা হয় হতদরিদ্র দল। এ দলের সদস্য হন রহিমা বেগম। নিয়মিত দলীয় সভায় সদস্যদের আত্মশক্তি উন্নয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ এবং ছাগল পালনের ওপর অন্যান্য সদস্যের মতো রহিমা বেগম প্রশিক্ষণে অংশ নেন এবং সফলতার সাথে প্রশিক্ষণ শেষ করেন।

প্রশিক্ষণেই তিনি স্বপ্ন দেখেন বাড়ির আঙ্গিনায় শাক, সবজি চাষ করে পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং অতিরিক্ত ফসল বিক্রি করে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালাবে। স্বপ্ন বাস্তবায়নে রহিমা বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষের জন্য মাটি উর্বর করার কাজ শুরু করেন। বিল থেকে কাদামাটি এনে বালিমাটির সাথে মিশান। গোবর কুড়িয়ে এবং রান্নার ছাঁই ও অন্যান্য আবর্জনার মাধ্যমে জৈবসার তৈরি করে ক্ষেতে ছড়িয়ে দেয়। বাড়ির সামনে দেড় শতাংশ জমি ৮টি প্লট করেন। উন্নয়ন সংঘের কর্মীরা শাক, সবজির বীজ বীনামূল্যে সরবরাহ করেন। প্রশিক্ষণে অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী বছরব্যাপী লাল শাক, ডাটা, পালং শাক, আলু, মূলা, বেগুন, মরিচ, মিস্টি কুমড়া ও ভুট্টা চাষ শুরু করেন রহিমা।

রহিমা বেগম বলেন, দেড় হাজার ট্যাহার শাক, সবজি খাইছি। ছয়শ ট্যাহা বিক্রি করছি। এহন শাক, সবজি বাজার থাইক্যা কিনি না। ঘরের ছেইনছেতেই চালকুমড়া, সিম লাগাইছি। আল্লাহ আমাগো দিন বদলাইয়া দিতাছে। এপির কাম আহনে আমাগো কপাল ফিরতাছে। এহন আমি বড় মাইডারের ইস্কুলে দিছি। সমিতিতে দুইশ ট্যাহা, ব্যাংকে দুইশ ট্যাহা কইরা জমা করতাছি।

সরেজমিনে গিয়ে সত্যিই পরিবর্তনের ধারা লক্ষ করা গেছে। তার এ পরিবর্তনকে আরো গতিশীল করতে জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে তিনটি ছাগী দেওয়া হয়েছে। দুটির গর্ভেই এখন বাচ্চা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ছাগী দুটি বাচ্চা প্রসব করবে বলে রহিমা জানান। রহিমা ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এখন স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করে এবং নলকূপের বিশুদ্ধ পানি পান করে। তাদের মধ্যে স্যানিটেশন জ্ঞান বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রাত্যহিক জীবনে চর্চাও করছে। বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন। ছেলেমেয়েদের যত্ন কিভাবে করতে হয় সেটাও দেখা গেছে। অভাব নামের কষ্টের পাখিটা এখন তার আঙ্গিনা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। এ রকম অসংখ্য রহিমা এপির আওতায় এসে নতুন জীবনের সন্ধান পাচ্ছে বলে এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে।

লক্ষ্মীরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান বলেন, জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রাম অত্র ইউনিয়নে কাজ করায় আমরা অনুপ্রাণিত এবং সন্তোষ্ট হয়েছি। সম্পদ চিহ্নিতকরণ, ভিডিসি গঠন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করা, যে কোন ধরনের সভা, সেমিনার করার ক্ষেত্রে আমরা সহায়তা প্রদান করছি।

রহিমা বেগমের বাড়ির আঙ্গিনায় শাক, সবজি ক্ষেত।ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

জানা যায়, জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এপির কর্মএলাকায় সর্বাত্মক সহায়তা করে থাকেন। তবে অনেকেই দাবি করছেন সরকারি সহায়তাগুলো সরাসরি তাদের কাছে আসলে সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার হবে। দুর্নীতি হবে না। বৈষম্য হবে না।

এলাকার প্রতিটি শিশু বিদ্যালয়ে গমন, স্যানিটেশন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, আয়মুখী কাজে মানুষের অন্তর্ভুক্তিকরণ, দুর্যোগ সম্পর্কীত জ্ঞান আহরণ, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রতিফলন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে। রহিমার ঘরের সাথে বসানো হয়েছে হ্যান্ড ওয়াশিং ডিভাইস। ব্যবহার করছে পরিবেশবান্ধব চুলা।

উন্নয়ন সংঘের জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক মিনারা পারভীনের সাথে কথা বলে জানা যায়, শিশুদের সর্বোত্তম সুরক্ষায় পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আমরা বহুমাত্রিক প্রশিক্ষণ, তাদের আয়বৃদ্ধির জন্য বীজ, ছাগল, বিভিন্ন ফলজ বৃক্ষের চারা বিতরণ করে থাকি। এছাড়া তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী যাতে ন্যায্যমূল্যে এবং হয়রানীমুক্তভাবে বিক্রি করতে পারে সে জন্য কালেকশন পয়েন্ট তৈরিসহ নানা ধরনের কৌশল অবলম্বনে দলের সদস্য এবং এলাকাবাসীদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। এছাড়া কারিগরি সহযোগিতা ও শস্যবীমা খোলার ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান করছি।

ওয়ার্ল্ড ভিশনের জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক সাগর ডি কস্তা বলেন, শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যে খানার স্থায়ী আয়ের উৎসে সহযোগিতা, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, ওয়াস, শিশু সুরক্ষা এবং অংশগ্রহণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের অবস্থা উন্নতির লক্ষ্যে জামালপুরে এরিয়া প্রোগ্রাম (এপি) ১০ বছর মেয়াদী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।

sarkar furniture Ad
Green House Ad