আফগানিস্তান : আমাদের কী চিন্তা করা উচিৎ, আমরা কী করছি

:: রেজাউল করিম রেজা ::
যেকোন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আমরা বাঙালিরা সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সর্বদা সরব থাকি। খবর সংগ্রহে, খবর জানতে ও তা নিয়ে চা দোকানে জ্ঞাত-অজ্ঞাত বিষয়ে নিজের জোরালো মতামত প্রচার করতে গিয়ে সাধারণ কথা-কাটাকাটি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফলা যুদ্ধ পর্যন্ত বাধিয়ে দিতে পারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সীমা নির্ধারণ করলাম তার কারণ শরৎ বাবু কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম, গাঁয়ের দুই অনাহারি দুই ক্রোশ হেঁটে যাইতেন খবরের কাগজ পড়ে বিশ্বযুদ্ধের অবস্থা জানতে এবং এটা নিয়ে নিজেদের জ্ঞানের প্রগাঢ়তা যাচায়ে তৎকালীন বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অক্ষশক্তির জার্মানি, জাপান, ইতালি কোথায় কোন চাল ভুল দিলো তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি করতে। যদিও তাদের পেটে দানাপানি সহসা পড়তো না। তার আগেও যে বাঙালির এই স্বভাব ছিলো না তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। দিনে দিনে স্বভাব একই রয়েছে শুধু পরিবর্তীত হয়েছে মাধ্যমের। এই ধরেন, বৃটিশ আমলে খবরের কাগজ, পাকিস্তান আমলে তার পাশাপাশি বেতার যন্ত্র, বাংলাদেশ আমলে তাদের পাশাপাশি টেলিভিশন এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ আমলে সব ছাড়িয়া ফেসবুক।

যাই হোক, সোজা পথে আসি। বর্তমানের কড়া আলোচ্য বিষয় আফগান পরিস্থিতি। কথা হলো, আমরা বাঙালিরা কি চিন্তা-ধারায় সেই পূর্ব-পুরুষের পথই মাড়াবো নাকি আধুনিক মানুষ হিসাবে নিজেদের চিন্তা-চেতনায় কোরআই সেভেন ভার্সন না হোক, অন্তত কোরআই থ্রি ভার্সনের সিক্স জেনারেশনে তো উত্তির্ণ হতে পারি। বলছিলাম আফগান পরিস্থিতি নিয়ে। আমাদের মধ্যে মোটামুটি তিন পক্ষ প্রকাশ্য। তালেবান পক্ষ, তালেবান বিপক্ষ এবং “কিছু কমুনা” পক্ষ। তালেবান পক্ষের দাবি তারাই দেশের প্রকৃত দাবিদার তারা মোজাহেদিন। বিপক্ষ বলছে তারা তো জঙ্গী, আবার গেলো আফগানিস্তান, যুগ কয়েক পিছিয়ে মহিলাদের আপাদমস্তক কালো বোরখার মধ্যে ঢুকে! “কিছু কমুনা” পক্ষ কিছু না বললেও তারা যে আগের দু’পক্ষের কোন এক পক্ষের তা বুঝার ক্ষমতা আপনার-আমার সবারই আছে।

তবে একবার ভেবে দেখেন তো, এইসব ভাবনা আমাদের ব্যক্তিক কিংবা জাতীয় পর্যায়ে দশমিক দশ শূণ্যের পরে এক সংখ্যা পরিমাণ কোন অবদান রাখতে পারে কি না! না পারে না। সবাই জানি, কিন্তু মানি না। যাই হোক আমাদের চিন্তা করা উচিৎ আফগানিস্তানের এই নতুন পরিবর্তনে আমরা কীভাবে লাভবান হতে পারি। হ্যাঁ, আমরা লাভবান হতে পারি। তার আগে আপনাকে কিছু পরিসংখ্যানিক তথ্য দিতে চাই।

বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ইন্টেগ্রেটেড ট্রেড সলোউশন (ডাব্লিওআইটিএস)-এর মতে ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের ৮৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিপক্ষে আমদানি ছিল ৮ হাজার ৫৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থ্যাৎ ব্যালেন্স অব ট্রেডে এটা আমদানি নির্ভর দেশ। আফগানিস্তান যেসব জিনিসপত্র বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে- তারমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো মোট আমদানির শতকরা ৩৩ ভাগ পেট্টোলিয়াম ও কয়লা জাতীয় পদার্থ, ১৫ ভাগ মেশিনারী যন্ত্রাংশ, ১৪ ভাগ খাদ্য সামগ্রী, ৯ ভাগ বেজ-মেটাল ও অন্যান্য, এছাড়াও তৈরি পোষাক, প্রযুক্তিপণ্যসহ আরও অনেক কিছু। তারা ইরান থেকে আমদানি করে শতকরা ১৪ দশমিক ৫৬ ভাগ, চীন থেকে শতকরা ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ, পাকিস্তান থেকে শতকরা ১২ দশমিক ৮৭ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে শতকরা ৯ দশমিক ১৫ ভাগ, তুর্কমেনিস্তান থেকে ৮ দশমিক ০৬ ভাগ। এছাড়াও জাপান, কাজাখস্তান, ভারত থেকে কিছু আমদানি করে। আফগানিস্তান বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ বিদেশী পোশাক কিনে থাকে। সাধারণত চীন, তুরস্ক, কোরিয়া, ইরান, ভারত এবং পাকিস্তান থেকে তাদের টেক্সটাইল পণ্য আমদানি করে থাকে।

আমাদের জাতীয় গণমাধ্যম ও অনলাইন সোসাইটির উচিৎ আফগানিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা কী কী বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে পারি সেটা নিয়ে আলোচনা করা। আসুন দেখা যাক কী কী ধরনের রপ্তানি পণ্য বা সেবা আমাদের রয়েছে যা আফগানিস্তানে রপ্তানি করতে পারি যেমন-

১। আমরা ওষুধ আর চিকিৎসা-সামগ্রী রপ্তানি করতে পারি;
২। তাদের ট্রেডিশনাল পোশাকগুলো তৈরি করে রপ্তানি করতে পারি;
৩। সিরামিক্স, মেলামাইন বা প্লাস্টিক সামগ্রী রপ্তানি করতে পারি;
৪। ব্যাটারি রপ্তানি করতে পারি;
৫। খাদ্য-সামগ্রী ও শস্য বীজ রপ্তানি করতে পারি;
৬। এনজিও দিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা রপ্তানি করতে পারি;
৭। তাদের ব্যাংক-বিমা এসবের শেয়ার এখনও কম দামে আছে, এসবে বিনিয়োগ করতে পারি;
৮। তাদের দেশে তুলা চাষে বিনিয়োগ করে কম দামে তুলা আমদানি করতে পারি;
৯। রড়-সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রপ্তানি করতে পারি;
১০। ধোলাইখাল-জিঞ্জিরায় তৈরি হালকা যন্ত্রাংশ রপ্তানি করতে পারি;
১১। সে দেশে আইটি দক্ষতা রপ্তানিসহ ছোট-খাটো বিনিয়োগ করেতে পারি, ইত্যাদি।

আমাদের উচিৎ আবেগের স্ববেগে আফগানিস্তানের বর্তমান পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে মূল্যহীন মুল্যায়ন না করে জাতীয় স্বার্থে কিভাবে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক চিন্তার প্রসার ঘটিয়ে কাজে অগ্রসর হওয়া।

আরেকটি বিষয় জেনে রাখুন, পরবর্তী বিশ্ব হবে লিথিয়াম ব্যাটারিচালিত ডিজিটাল যন্ত্রের বিশ্ব, আর ধারণা করা হচ্ছে যে আফগানিস্তানের যে পরিমাণ লিথিয়াম মজুদ আছে তা লিথিয়ামের মজুদে শীর্ষ দুই দেশ চিলি ও বলিভিয়ার চেয়েও বেশি।

লেখক : রেজাউল করিম রেজা,
ব্যাংকার।

তথ্যসূত্রঃ
উইকিপিডিয়া;
ওয়ার্ল্ড ইন্টেগ্রেটেড ট্রেড সলোউশন (ডাব্লিওআইটিএস);
স্ট্যাটিসটিকা.কম;
এমকে ইসলাম, এডিসি, ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ এবং
হাবিবুর রহমান, স্মার্ট ফ্যাক্টরি ৪.০ কনসালট্যান্ট।