সোহেলের শিকলবন্দি জীবন চলবে আর কতদিন!

বাড়ির কাছেই ফাঁকা মাঠে সারাদিন এভাবেই খুঁটির সাথে শিকলে বেঁধে তালা লাগিয়ে রাখা হয় মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক সোহেলকে। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
বাংলারচিঠিডটকম

মানসিক ভারসাম্যহীন শিকলবন্দি সোহেলকে (২৫) চিকিৎসা করাতে না পেরে বিপাকে ও শঙ্কায় রয়েছেন তার বিধবা মা জাহানারা। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তার চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে গেছে। একদিকে নিজের সন্তান বলে তাকে ফেলেও দিতে পারেন না, অন্যদিকে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া বা প্রতিবেশী কারো ক্ষতি করার শঙ্কায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় তাকে। প্রায় ১৩ বছর ধরে চলছে সোহেলের শিকলবন্দি জীবন। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের খায়েরপাড়া গ্রামে মৃত আবু বক্করের ছেলে সোহেল। তার চিকিৎসার জন্য আকুতি জানিয়েছেন তার মা বিধবা জাহানারা।

সোহেলের পরিবার সূত্র জানায়, মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের খায়েরপাড়া গ্রামের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান সোহেল। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সোহেল তৃতীয়। বোন শিবলীর বিয়ে হয়ে গেছে। বড়ভাই রুবেল ঋণ করে কাজের সন্ধানে গেছেন সৌদী আরবে। জন্ম থেকেই সে মানসিক ভারসাম্যহীন। শৈশবে কিছুটা কম থাকলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মানসিক ভারসাম্যহীনতাও বাড়তে থাকে। সাত বছর বয়সে সোহেল টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসায় তার জ্বর ভালো হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। জামালপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করে কিছুদিন তাকে চিকিৎসাও করিয়েছেন স্বজনরা। কিন্তু কোন কাজে আসেনি। বছর দেড়েক হলো তার বাবা আবু বক্কর মারা গেলে সোহেলকে নিয়ে আরো বেশি বিপাকে পড়েন তার মা জাহানারা। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সোহেলের চিকিৎসাও থেমে গেছে।

মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে সোহেলের উৎপাতও বাড়তে থাকে। মাঝে মধ্যে বাড়ি থেকে চলে যায়। আবার ফিরে আসে। পরিবার ও প্রতিবেশীরা তাকে নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে বাড়ির সামনে কংক্রিটের খুঁটিতে শিকলে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় তাকে। সারাদিন সেখানেই থাকে। সেখানেই তাকে খাবার দেওয়া হয়। খাবারও খেতে চায় না। রাতেও তাকে একইভাবে শিকলে বেঁধে রাখতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে রাতে তাকে রাখা হতো গোয়াল ঘরের এক কোনায়। কিছুদিন ধরে রাতে থাকার ঘরের মাচার পাশে খুঁটিতে বেঁধে থাকতে দেওয়া হচ্ছে। প্রায় ১৩ বছর ধরে এভাবেই তাকে শিকলে বেঁধে, অনেক কষ্ট সহ্য করে বুকে আগলে রেখেছেন তার মা।

সোহেলের মা জাহানারা বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘অরে ছাইড়া দিলে বাড়ি থেইকা চইলা যায়। মানুষেও বালা চোখে দেহে না। আমারে সবাই সোহেল পাগলার মাও কইয়া ডাহে। তাই শিকল দিয়া বাইন্দা রাইখা পালতাছি। আমার ছেলেডার মেলা কষ্ট। একদিন ঘুমাইলে পরে তিন-চারদিন যায় আর ঘুমায় না। চিন্তায় চিন্তায় অর বাপটা মরলো। ছেলেডারে সুস্থ করবের যাইয়া অর বাপে মেলা টাকা পয়সা খরচ করছে। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর তনে মেলা কষ্টে আছি। চিকিৎসা করাবের না পাইয়া ছেলেডারে এহন আল্লাহর উপরে ছাইড়া দিছি। আমার পেটের সন্তান। অরে ত আর ফালাই দিবার পাই না। আমি অরে সুস্থ করবের চাই। কেউ আমার ছেলেডার চিকিৎসার দায়িত্ব নিলে আমার মেলা উপকার হইতো।

ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. শাহজাহান আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, সোহেল আমার চাচাত ভাই। জন্ম থেকেই সে মানসিক প্রতিবন্ধী। মাস ছয়েক আগে সোহেলের নামে একটা প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দিছি। ছেলেটার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তার মা জাহানারা খুবই বিপাকে পড়েছেন তাকে নিয়ে। তাকে নিয়মিত চিকিৎসা করানোর সামর্থ নেই তার মায়ের। তাকে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে সে।