ঘরবন্দি বৈশাখী উৎসব ও কিছু কথা

।। জাহিদুর রহমান উজ্জল ।।
উৎসবকে কখনো ঘরে বন্দি করা যায়? না এই উৎসব কিন্তু বাঙালীদের সার্বজনীন অনুষ্ঠান। হাজার বছর থেকে চলে আসা এই উৎসবকে ঘিরে বাঙালির আশা, আকাঙ্ক্ষা, সামজিক যোগাযোগ, ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষির অগ্রগতি, লেনদেন, উন্নয়ন পরিকল্পনা, এক কথায় সব কিছু জড়িত। উৎসব মানে লাখো মানুষের মিলনমেলা। আত্মার সাথে আত্মার মিলন। পারস্পারিক যোগাযোগ, ভাবের আদান প্রদান। এই বিশালতাকে আজকের করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আমরা বাধ্য হচ্ছি ছোট পরিসরে নিয়ে আসতে। উৎসব হয় মানুষের কল্যাণে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যর্থাথই বলেছেন, ‘তাপস নিঃশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক’।

আজকের বিশ্বে মহামারী যে আকারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস নামে মরণঘাতী ব্যাধি, তা মারাত্মক। ছোঁয়া ছোঁয়ীতে এর সংক্রামক ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো বিশ্বটাকে একঘরে করে দিয়েছে।

চোখে দেখা যায় না, এমন ক্ষুদ্র একটি জীবাণুর কারণে পৃথিবীর সব মানুষ প্রায় ঘরবন্দি। সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। পুরো বিশ্ব অবরুদ্ধ।

ভাইরাসের সাথে কিছু নতুন শব্দে আমরা পরিচিত হয়েছি যেমন, লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন। বাঙালি মননে মগজে এই শব্দগুলি কখনো ছিলো না। কারণ বাঙালি স্বাধীনচেতা মানুষ। তারা বাঁধা থাকার নয়। সব সময় শিকল ভাঙ্গার গান গায়। সুষ্ঠু, সুন্দর পরিস্কার, পরিচ্ছন্নতায় যাদের জীবন গড়া তাদের আবার ভাইরাস দেখে ভয় পাওয়ার কি আছে? এই বধ্যমূল ধারণা ছিল। কিন্তু এই ভাইরাস তো পারমাণবিক বোমার চেয়ে শক্তিশালী জানা ছিল না। বাঙালি কখনো এমন ভয়াবহতার মধ্যে পড়েনি। তারা বীরের জাতি, সাহসী মানুষে ভরপুর এই দেশ। বঙ্গোপসাগর সাগরের মতো বিশাল হৃদয় তাদের। প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করা জাতি হলো বাঙালি।

এই বাঙালি ভয় পাওয়ার জাতি নয়। মারাঠা, বর্গীদের সাথে জয়ী হওয়া জাতির নাম বাঙালি, ইংরেজদের সাথে জয়ী হওয়ার নাম বাঙালি, পাকিস্তানিদের সাথে জয়ী হওয়ার নাম বাঙালি। এই জাতিকে কেউ কখনো দাবায়ে রাখতে পারেনি। বাঙালি জাতির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবানা।’। পরেনি কেউ। সব সময় তারা সাহসী মানুষের সারিতে প্রথম হয়ে থেকেছেন। আজ এই ক্রান্তিকালে মানুষকে বুঝিয়ে ঘরে রাখা হয়েছে। কিন্তু মানুষ কি উৎসবের গন্ধ পেলে ঘরে থাকে? এবার থাকতে বাধ্য হচ্ছে। দেহটা ঘরে থাকলেও উৎসব প্রিয় বাঙালির মনটা পড়ে আছে রমনার বটমূল, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায়, বটতলা, নদীর পাড়ে স্কুল মাঠে বৈশাখী মেলায়, দিগন্তজোড়া মাঠে ঘুড়ির উৎসবে।

বন্দি জীবনের যতো কষ্ট আজ কিছুটা লাঘব হবে। এ জন্যই যে, বন্দি জীবনে পরিবার নিয়ে বৈশাখটা পালন করবেন। হোক না ছোট পরিসরে। এই উৎসবকে আমরা আরো বর্ণিল আকারে বাড়িতে বসে অনলাইনের মাধ্যমে পালন করতে পারি। লকডাউনের এই মৌসুমে ই-কর্মাস এর ওপর ভরসা রাখতে পারি। পোষাক থেকে সাজসজ্জার সবকিছুই মিলবে। মিলবে ঘর গুছানোর সব কিছু। অনলাইন থেকে বৈশাখের গানগুলি বাজিয়ে নিতে পারেন এলইডি স্ক্রিনে। বাড়ির শিশুদের সাজিয়ে নিজস্ব বাড়ির ছাদ অথবা ড্রয়িং রুমে মিনি আকারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে পারেন। সাথে প্লেয়ারে সুর তুলে বাজবে বৈশাখী গান। কি অপূর্ব তাই না?

এছাড়া ঘরে বসে বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী খাবারের রান্নাগুলি দেখে নিতে পারেন ইউটিউবসহ নানা সাইটে। এর জন্য কেকা ফেরদৌসি বা ওপার বাংলার সুদিপা’র ‘হেংলা হেসেল’ দেখে নিতে পারেন। যোগাযোগ করুন সামজিক মাধ্যমে। আড্ডা বা দেশ বিদেশের বন্ধু বা আত্মীয়র সাথে সংযুক্ত হোন লাইভে । ইচ্ছে থাকলে সব হবে।

আসলে মুক্ত মানুষ ঘরে বন্দি থাকলে মনের উর্বরতা কমে যায়, আনন্দের মাঝে বিষাদের ছায়া পড়ে। করোনার এই ভয়াল থাবায় মানুষ যখন দিশেহারা, তখন একটি পুরোনা বছর চুপিচুপি বিদায় নিলো। পূর্ব গগনে লাল সূর্য্যে উদয় হলো আরো একটি নতুন বছর। এই বছরে মানুষ যেভাবে বন্দি অবস্থায় পহেলা বৈশাখ পালন করলো। আর যেন কোন দিন এমন না হয়।

বৈশাখ আসে সদম্ভ পায়ে, বিস্ফোরিত চোখ, ত্বরিত তিলক আঁকা, উদ্দাম পেশী, বিস্তৃত বক্ষদেশ, যেন এক জটধারী যুবা সন্ন্যাসী, সঙ্গে শত সেবা দাসী, অন্তঃসত্বা মেঘ-গোপিনীরা। বৈশাখ কখনো বিদ্রোহী ‘ঘনশ্যাম’ বিক্ষুদ্ধ নকীব, তাই তার অন্য পরিচয় ‘কাল বৈশাখী’।

ওইসব জেনেও উৎসবে মেতে উঠে উৎসব প্রিয় বাঙালি । আজকের করোনার করালগ্রাসে মানুষ শংকিত, ভীতু হয়ে উঠেছে বাইরে বেরুলেই বিপদ। ছোঁয়া যাবে না, ধরা যাবে না, বলা যাবে না কথা। এই অবস্থা এখন মানুষের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। প্রতিটি বাঙালি আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকেন এই উৎসব। এ বছর বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে পয়লা বৈশাখের বহিরাঙ্গণের সকল অনুষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘যে আঁধার আমাদের চারপাশকে ঘিরে ধরেছে, তা একদিন কেটে যাবেই। বৈশাখের রুদ্র রূপ আমাদের সাহসী হতে উদ্বুদ্ধ করে। মাতিয়ে তোলে ধ্বংসের মধ্য থেকে নতুন সৃষ্টির নেশায়।’

তাঁর কথার সূত্র ধরে বলতে চাই ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা অঘ্রানে নবান্নে উৎসবে,
সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়__ বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে।।

১লা বৈশাখ ১৪২৭