সমস্যা সম্ভাবনার দোলাচলে জামালপুরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, রোগীর ভারে ন্যুব্জ জেনারেল হাসপাতাল

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

বিশেষ প্রতিবেদক 
বাংলারচিঠিডটকম

জেলায় ২৬ লাখ মানুষের বাস হলেও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে সেবা নিতে আসে পার্শ্ববর্তী ৬ জেলার আরো অসংখ্য মানুষ। এরমধ্যে টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও বগুড়ার জামালপুর সীমন্তঘেষা উপজেলার মানুষ নিকটবর্তী হওয়ায় জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সেবা নিতে আসে। বলা যায় জামালপুর স্বাস্থ্যসেবার দিকে তাকিয়ে থাকে কমপক্ষে ৩০ লাখের অধিক মানুষ। অথচ অবকাঠামো সঙ্কট, চিকিৎসক, নার্সসহ তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অসংখ্য পদ শুন্য পড়ে আছে। অপরদিকে দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়া, তথাকথিত রাজনৈতিক ও এলাকার প্রভাব এবং দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে সাধারণ রোগীদের প্রতিদিন পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ।

সম্প্রতি জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে অনেক নেতিকবাচক এবং ইতিবাচক দিকও উঠে এসেছে। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক চিকিৎসক প্রফুল কুমার সাহার লিখিত তথ্যে জানা যায়, জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে মঞ্জুরীকৃত চিকিৎসকের পদ ৯২ জন থাকার কথা সেখানে আছে মাত্র ৪৯ জন। সেবা তত্ত্বাবধায়ক, উপসেবা তত্ত্ববধায়ক, নার্সিং সুপাভাইজার, সিনিয়র স্টাফ নার্স, সহকারী নার্সের পদ ২০৬ মঞ্জুরী থাকলেও সেখানে আছে ১৮২ জন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থাকার কথা ৫৩ জন আছে ৩৬ জন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারির পদ ১১৭ জনের মধ্যে বাস্তবে আছে ৭৫ জন। অথচ হাসপাতালে ২৫০ জন রোগীর জায়গায় প্রতিদিন গড়ে রোগী থাকে ৫৫০ থেকে ৬০০ জন। অন্য ৬ উপজেলায় মঞ্জুরীকৃত চিকিৎসক ১৭৭ জনে মধ্যে কর্মরত আছে ৪৮ জন। ডেপুটেশনে আছে ৩৮ জন। আর বাকি পদ শুন্যের কোঠায়।

জরুরি যন্ত্রপাতির মধ্যে আল্ট্রাসাউন্ড চারটির মধ্যে দুটি অচল। ইসিজি মেশিন নয়টির মধ্যে চারটি অচল। এক্স-রে মেশিন একটি অচল, ১টি সচল। এনেসথেসিয়া মেশিন ৮টির মধ্যে ২টি অচল। লেপারসকোপি মেশিন একটি অচল, একটি সচল। ডেন্টাল ইউনিট একটি অচল, একটি সচল। কোটি টাকা মূল্যের জেনারেটর অধিকাংশ সময়ই বিকল হয়ে থাকে। লিফ্ট প্রায় সময়ই বন্ধ থাকে। যন্ত্রপাতি এবং শুন্যপদ পূরণে বারবার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে লেখলেও কোনো কর্ণপাত করা হয় না।

বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আইসিইউ উদ্বোধন করলেও গত তিন বছরেও চালু হয়নি। একটি সিসিইউ এর অভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক রোগীই মৃত্যুবরণ করেন।

২০১৯ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত পরিসংখ্যানে জানা যায় অন্তঃবিভাগে ৩৬ হাজার ২৬৫ জন এবং বহির্বিভাগে দুই লাখ ৩২ হাজার ৮৬৪ জন রোগী জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে সেবা নিতে এসেছে। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক রোগী সেবাদানে হিমশিম ক্ষেতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। রোগী ও রোগীর স্বজনদের সাথে হাসপাতাল স্টাফদের প্রতিদিন হট্টগোল লেগেই থাকে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দুই একজন ডাক্তার, নার্স ব্যতীত অধিকাংশদের ব্যবহার রোগীবান্ধব নয়। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিরা তো সন্ত্রাসীদের মতো আচরণ করে। এদের হাতে শুধু রোগীরাই নয়, ডাক্তার, নার্সরাও অনেক সময় লাঞ্ছিত হয়ে থাকে। এরা রোগীদের বিছানা বাবদ ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা উৎকোচ নিয়ে থাকে। অধিকাংশই এরা দালালি করে থাকে। বেসরকারি ক্লিনিক ও ওষুধের দোকানগুলোর সাথে তাদের ভীষণ সখ্যতা। রোগী পাঠালেই কমিশন। হাপতালের বিনামূল্যের ওষুধগুলোর অধিকাংশই এদের পকেটে উঠে। ডাক্তাদের ওপর জোর খাটিয়ে এরা ওষুধের স্লিপ নিয়ে থাকে। এদরে মধ্যে আবার অনেকেই আছে মাস শেষে হাসপাতাল থেকে বেতন উত্তোলন করলেও বাইরে অন্য পেশার সাথে যুক্ত থাকে। জামালপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী হাকিম ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এদের অনেককেই দন্ড দিয়েছেন। তবে এদের গডফাদাররা বিশাল শক্তিশালী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যোগসাজসে আউটসোর্সিং এর লাখ লাখ টাকা অনৈতিকভাবে এদের পকেটে উঠছে। দেখার কেউ নেই।

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির অনিয়মিত সভার ফলে কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই। কমিটির বর্তমান সভাপতি জামালপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য প্রকৌশলী মোজাফ্ফর হোসেন প্রতিমাসে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠানের জোর তাগাদা দিয়েছেন বলে কমিটির সূত্র জানায়।

সাধারণ রোগীদের সুবিধা এবং সাশ্রয়ের জন্য হাসপাতাল প্রাঙ্গণে একটি ক্যান্টিন এবং একটি ওষুধের দোকান নির্মাণের জন্য সম্প্রতি কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু কোনোরূপ দরপত্র আহ্বান বা কার্যাদেশ ছাড়াই একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে কাঁচা ঘর নির্মাণ করছে। এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং এলাকাবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এই খাত থেকে আয়ের অর্থ হাসপাতাল রোগী কল্যাণ সমিতির তহবিলে জমা হওয়ার কথা থাকলেও এ ব্যপারে কমিটি কিছুই জানে না। হাপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট হতে পারছে না সাধারণ মানুষ।

তবে সম্ভাবনা এবং আশার কথা হলো জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের ৫০জন শিক্ষার্থী চলতি বছর শেষে শিক্ষাবর্ষ শেষ করে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নিশিপ করবে। এতে স্বাস্থ্যসেবার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।

প্রতিদিন হাসপাতালে রোগীদের অপারেশন এবং অন্যান্য জটিল রোগের চিকিৎসা হলেও মঞ্জুরিকৃত ১৫টি পদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছে মাত্র একজন। জুনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ১৪ জনের মধ্যে আছে মাত্র সাত জন। শুন্যপদগুলো পূরণ করা হলে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের সেবার মান আশাব্যঞ্জকহারে বৃদ্ধি পাবে বলে অভিজ্ঞ মহল আশা করছেন।

জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল রোগী কল্যাণ সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম এই প্রতিনিধির কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, হাসপাতালের রেফার সংস্কৃতি, দালালদের দৌরাত্ম এবং ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে সাধারণ রোগীদের দুর্ভোগ কমে আসবে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি হবে।