বকশীগঞ্জে ১৪ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মানবেতর জীবনযাপন

রৌশনারা দাখিল মাদরাসা এখন গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। ছবি : বাংলারচিঠি ডটকম

বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি
বাংলারচিঠি ডটকম

জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় ১৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) না হওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এতে করে মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরা নিয়মিত পাঠদান না করানো এবং নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে না আসায় শিক্ষার্থীদের উপর এর প্রভাব পড়ছে। ফলে পিছিয়ে পড়ছে চরাঞ্চলের কয়েক শত শিক্ষার্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বকশীগঞ্জ উপজেলায় ৫টি কলেজ, ২৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৮টি দাখিল মাদরাসা ও ৭টি নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ৫টি কলেজের মধ্যে দুটি কলেজ এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। ২৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে চন্দ্রাবাজ হুসনেয়ার ওসমানী বালিকা বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত হয়নি। তবে ১২টি বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এমপিওভুক্তি রয়েছে। ১৮টি মাদরাসার মধ্যে এমপিওভুক্ত হয়নি চারটি দাখিল মাদরাসা। এ ছাড়াও ৭টি নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে একটিও এমপিওভুক্ত হয়নি।

সরেজমিনে দেখা গেছে নন এমপিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের চিত্র। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিলাখিয়া পাবলিক কলেজ। বার বার চেষ্টা করেও এমপিওভুক্ত করা যায় নি এই কলেজ। কলেজ এমপিওভুক্ত করতে গিয়ে কয়েক লাখ টাকা খুইয়েছেন অধ্যক্ষ মশিউল আলম। তবুও স্বপ্ন পূরণ হয় নি এই কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের। বর্তমানে বেতন ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী।

অবিলম্বে এই কলেজটি এমপিওভুক্ত করতে শিক্ষামন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন কলেজের অধ্যক্ষ মশিউল ইসলাম।

সাধুরপাড়া ইউনিয়নের আইরমারী ইসলামিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার অবস্থা আরো বেহাল। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মাদরাসাটি। প্রায় দুই যুগ পার হলেও এমপিও হয়নি চরাঞ্চলের এই মাদরাসা। একটি চারচালা টিনের ঘরে ভাঙা বেঞ্চে কোনো রকম পাঠদান হলেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো ভবন নির্মাণ করা হয় নি। যুবক বয়সে চাকরিতে যোগ দিলেও শিক্ষকরা আজ বৃদ্ধে পরিণত হয়েছে অথচ বেতন-ভাতা চোখে দেখেন নি। টাকার অভাবে ভাল পাঞ্জাবি কিনতেও পারছেন না তারা। বেতন-ভাতা না পেয়ে কোনো রকম জীবন পার করছেন এই মাদরাসার শিক্ষকরা। তবুও তারা শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন। অনেকেই আবার বেতন না পেয়ে মাদরাসাতেও নিয়মিত আসতে চান না।

এই মাদরাসার সুপারিনটেনডেন্ট মো. সাইফুল ইসলাম জানান, আমাদের পেটে ভাত না থাকলে কিভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াবো। শিক্ষক হয়ে আমরা অসহায় জীবন যাপন করছি। আমরা এই সরকারের আমলে এমপিওভুক্তির আশা করছি।

১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বকশীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সূর্য্যনগর রৌশনারা দাখিল মাদরাসা। সরেজমিনে দেখা গেছে, এই মাদারাসায় এখন আর কোনো ক্লাস নেয়া হয় না। মাদরাসাটিতে রাতের বেলায় শেয়াল বসবাস করে। টিনশেড ঘরের চাল থাকলেও বেড়া ভেঙে চুরে গেছে কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ে। বেতন-ভাতা ও সরকারি বরাদ্দ না থাকায় মেরামত করা হয়নি মাদরাসার ঘর। এই মাদরাসায় মোট ৩২০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০১৯ সালে ৫ জন শিক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেবে। অথচ এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা কোচিং নির্ভর হয়ে পড়েছেন।

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বগার চর ইউনিয়নের ঘাসির পাড়া (বাংগাল পাড়া) দাখিল মাদারাসা। এই মাদারাসার শিক্ষক মোহন আলী জানান, নিজের ঘরে খেয়ে আর কত সার্ভিস দেব। এভাবে আর সংসার চলছে না। তবুও শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মাদরাসায় যাচ্ছি। বেতন না পেয়ে ১৯ জন শিক্ষক কর্মচারী খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে বলেও জানান এই শিক্ষক। কবে এমপিওভুক্ত হবে তাও ঠিক নেই। এ বছর ২০ জন শিক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেবে এই মাদরাসা থেকে।

এমপিওভুক্ত করণের আশা ছেড়ে দিয়েছেন মেরুরচর ইউনিয়নের মাদারের চর নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ২০০২ সালে এই বিদ্যালটি প্রতিষ্ঠা হলেও আজ অবদি এমপিও হয়নি এই বিদ্যালয়। একটি টিনশেড ঘর ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি এই প্রতিষ্ঠানের।

নিলাখিয়া আবদুস ছালাম বালিকা বিদ্যালয়টি সুনামের সাথে পরিচালিত হলেও এমপিও হয়নি। ভাল ফলাফল হলেও বেতন পাচ্ছেন না এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা।

উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদান হলেও ২৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টি বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যন্ত এমপিও রয়েছে। তবে এই ১২টি বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।

এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষকরা নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে না আসায় পাঠদানও ঠিক মত হয় না। এ কারণে বাধ্য হয়ে তাদেরকে কোচিংমুখি হতে হচ্ছে। ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এই সব এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র পাসের হার বাড়লেও পড়াশুনা মানসম্মত হচ্ছে না।

বকশীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন জানান, ২০১০ সাল থেকে এমপিও বন্ধ থাকায় বকশীগঞ্জের প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত হচ্ছে না। এমপিও শুরু হলেই আমরাও শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগিতা করব। অসহায় শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে এমপিও ছাড়া উচিৎ বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা।