সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মাদারগঞ্জ : শৈশব থেকে দেখে আসা শারদীয় দুর্গোৎসব

জাহিদুর রহমান উজ্জল::
দুর্গাপূজা কখন হবে আগে থেকেই খবর পেয়ে যেতাম আমাদের পারিবারিক নরসুন্দর সুধীর কাকার মাধ্যমে। তিনি ক্ষৌরকর্ম করার জন্য সপ্তাহে একদিন আমাদের বাড়িতে আসতেন। তিনি লোকনাথ পুঞ্জিকা ঘেটে বাবাকে বলে যেতেন আশ্বিন মাসের এতো তারিখে পূজা হবে। দুর্গা দেবী এবার কি বাহনে আসবে। ইত্যাদি সব বিষয়। পূজার জন্য তিনি গ্রাম থেকে নারকেলসহ নানান পদ যোগাড়ে ব্যাস্ত ছিলেন। আমাদের বাড়ির নারিকেল ছিলো তার স্পেশাল। পূজার ক’দিন খুব ব্যস্ত থাকবেন তিনি। তাই আগে ভাগেই কাজ করতেন।

শরৎ এলেই বাড়ির পাশে যমুনার চরে সাদা মেঘের মতো কাশফুল ফুটতো। কাশফুলের সাথে পূজার সম্পর্ক তখনো বুঝি নাই। তবে পাশের গ্রামটি ছিলো হিন্দু অধ্যাসিত। পুরোপাড়ায় সনাতন হিন্দুরা বসবাস করতো। ঘোষপাড়ার লোকজনের সাথে আমাদের ভালো উঠাবসা ছিলো। তাদের পাড়ায় আমাদের ক্ষেত খামার ছিলো। তাই পূজা এলে তারা নিমন্ত্রণ দিতে আসতো আমাদের বাড়িতে। সেই সুবাদে পূজা দেখা।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মাদারগঞ্জ। ১৯৪৭-১৯৫০ সালের দাঙ্গার সময় সারাবাংলায় হিন্দু মুসলিমের যে সংঘাত শুরু হয় সে সময় মাদারগঞ্জ ছিলো শান্ত।

এই এলাকায় প্রভাবশালী মুসলিম এর এমএনএ থাকার পরেও হিন্দুদের ওপর কোন দাঙ্গার প্রভাব পড়ে নাই। তৎকালীন সময়ে এ কে এম বফাত উদ্দিন তালুকদার এমএনএ ছিলেন। ভারত ভাগের বিপক্ষে মুসলিমলীগের যে কয়েকজন এমএনএ ভোট দিয়েছিলেন তারমধ্যে এ কে এম বফাত উদ্দিন তালুকদার অন্যতম। ভয়াবহ দাঙ্গার সময় অনেক প্রভাবশালী হিন্দু পরিবার তাঁর বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে দাঙ্গায় সামান্য পরিমাণ হিন্দু পরিবার দেশ ত্যাগ করেছিলো। তবে দাঙ্গার কোন প্রভাব পড়েনি। ১৯৪৭ ও ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর এই অঞ্চলের সংখ্যালঘু পরিবারগুল নিরাপদে জীবন যাপন করতে থাকে।

তেমনি ১৯৭১ সালেও হিন্দু পরিবারগুলো তালুকদার পরিবারের কাছে আশ্রয় নেয়। তাদের মাধ্যমে তারা অনেকেই নিরাপদে ভারতে চলে যায়। আওয়ামী লীগের এমপি করিমুজ্জামান তালুকদার ও আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিক উদ্দিন তালুকদার সেই সময় সংখ্যালঘুদের রাজাকার ও আল বদরের হাত থেকে রক্ষা করতে ও তাদের মালামাল লুটপাট ঠেকাতে সারা থানায় হিন্দু অধ্যাসিত এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করেন। এতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ২/১ ঘটনা ছাড়া বড় কোন ঘটনা ঘটেনি। এমন কি মুক্তিযুদ্ধে এই থানায় একজনও সংখ্যালঘু শহীদ, গুম, নির্যাতিত হয়নি। যা ছিলো সারা বাংলাদেশের একটি দৃষ্টান্ত।

১৯৯১ সালের পর থেকে এই এলাকার সাংসদ মির্জা আজমের ছায়াতলে রয়েছে সংখ্যালঘু মানুষগুলো। বিন্দুমাত্র নিরাপত্তার অভাব নেই তাদের। ১৯৯২ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় সারা দেশে যে দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। অজস্র মন্দির ভেঙ্গে ফেলা হয়। খুন জখমের ঘটনা ঘটে, কিন্তু মির্জা আজম তাঁর এলাকা কঠোর হস্তে তা রক্ষা করেন।

যুগে যুগে মাদারগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায়ে রয়েছে এমনি ভাবে।

যাক সে কথা, ফিরে যাই স্মৃতির সেই ছোটবেলায়। যে কদিন দুর্গোৎসব চলতো প্রায় রাতেই তাদের আরতি দেখতে গেছি। এই দিনে প্রায় ২শ বছর ধরে চলে আসা চিন্তেশ্বর বর্মণের বাড়ির উঠোনে পূজার মেলা বসতো। মেলায় অন্যসব কিছু না পাওয়া গেলে মাটির খেলনা, তৈজসপত্র, সাংসারিক জিনিস, লোকখাবার মুড়ি মটকি, জিলাপী, গজা, সাজ।

মেলায় লেসফিতা, আলতা, চুড়ির দোকান ছিলো। বিক্রি হতো তাজা ইক্ষু। বরাবর ইক্ষু কিনেই বাড়ি ফিরতাম।

পূজার মেলায় প্রচুর জুয়া চলতো। চরকি কিম্বা ছয়গুটির জুয়া নিয়ে দলে দলে লোক বসে থাকতো। তাতে টাকা পয়সা লাভ ক্ষতির পরিমাণের চেয়ে আনন্দটা বেশি ছিলো মানুষজনের।

দাদা, বৌদি কাকা-কাকীর পোষাক পরিচ্ছেদ দেখে বুঝা যেতো পূজা কতোটা আনন্দের।

এই এলাকার সনাতন হিন্দু পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। মৎস্যজীবী বা ঘোষ সম্পদায় জুড়ে বড় একটা অংশ ছিলো। বাকীরা সাহা, কৈবর্ত, দাস, কর্মকার, রায় ও অভিজাত ঠাকুর পরিবার ছিলো।

পূজা এলে মৎস্যজীবী ও ঘোষ পরিবারের সারা বছরের অভাব অনটন চোখে পড়তো না। তারা উৎসবের দিনের জন্য গঞ্জের বাজার থেকে গজ কাপড়, থান কাপড়ে সাজসজ্জা হতো। পাবনা টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি ছিলো গৃহবধূদের চাওয়া পাওয়ার শেষ অধ্যায়।

এখন সেই গঞ্জের বাজারে নানা সাজসজ্জার শোরুমে ম্যানিকুইনের গায়ে পড়া শাড়ি, লেহেঙ্গা, শার্ট, পাঞ্জাবি কিনতে লম্বা সারি। কাপড়চোপড়ের সাথে যোগ হয়েছে বাড়ির ফার্নিচার থেকে ফ্রিজ টিভি কেনার বায়না। পাল্টে গেছে জীবন যাত্রা।

আগে কিশোরী তরুণীরা বাড়ির সাজে বাইরে বেরুতো। এখন হাল ফ্যাশনের ড্রেসের সাথে পার্লারের মেকঅভার, হেয়ার স্টাইল বদলে গেছে এই এলাকার পূজার চিত্র।

পূজার বাজেট বেড়েছে ফোরজির এই দুনিয়ায় ঢাকের শব্দকে তুড়ি মেরে গর্জে উঠে ডিজে। শব্দের ভয়াবহতার মাঝে পশ্চিমা নৃত্য শরীর দোলানোর প্রতিযোগিতা। সেলফোনের পর্দায় ভেসে বেড়ায় এ পাড়া ও পাড়ার মণ্ডপের ছবি। রাত্রি দীঘল সময়ে আরতির সরাসরি সম্প্রচার।

সেলফোনের কল্যাণে দর্জিবাড়ির ভিড় ঠেলতে যাবার কি প্রয়োজন। মুঠোফোনে এক ক্লিকে অনলাইন থেকে দামি দামি ব্যান্ড এর পোষাক এসে হাজির।

সময় পাল্টে গেছে, বাজার হাটে কাপড় বানানোর দর্জির চাকা প্রায় থেমে গেছে। রেডিমেড কাপড়ের কাছে। দলে মানুষ ভিড় করে চোখ ধাঁধানো শোরুমে। নিজের পছন্দের পোষাক নিজে কিনে।

পূজার মণ্ডপে মাইকে রের্কড বাজতো। হিন্দি বা পুরানো দিনের ভারতীয় বাংলাগান। লাল, নীল সবুজ কাগজের মালা, রাংতার জড়ির সাজসজ্জা হতো। হ্যাজাক বাতির চমৎকার আলো এবং ধুপের মহিতকরা গন্ধ মাতিয়ে তুলতো মণ্ডপগুলোকে। সেইস্থান দখল করেছে এখন ডিজের ভয়ংকর শব্দ। সাজসজ্জায় এলইডির বাহারি আলো। ডেকোরেশন এর অঙ্গশোভা।

পূজার শেষ আকর্ষণটি ছিলো খরকা বিলে দেবীর বিসর্জন পর্বটি।

মেলার পাশেই ছিলো খরকা বিল এই বিলে বড় বড় নৌকায় দুর্গা প্রতিমা তুলে বিলের চারিদিকে সাতটি পাক দিয়ে সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় দেবীকে তারা বাপের বাড়ি পাঠাতো। নৌকায় ধুপদানী নিয়ে নাচের আদলে আরতি দিয়ে। আর নৌকার মাস্তুলে বাঁধা মাইকে চলতো হিন্দি গান। সূর্যিমামা পশ্চিম আকাশে চলে গেলে আমরা ফিরে যেতাম ঘরে, তখন প্রাচীন মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি।।

লেখক: সভাপতি মাদারগঞ্জ প্রেসক্লাব।
রচনাকাল: ০৪.১০.২০২২