বৈশাখী উৎসব ও জামালপুরের লোকমেলা

গ্রাম বাংলার মেলা। -পুরনো ছবি

॥ জাহিদুর রহমান উজ্জল ॥
নশ্বর পৃথিবী প্রতিনিয়তই আরম্ভের পক্ষপাতি। সারা হওয়ার অনিবার্যতা জেনেও মানুষ মেতে উঠে শুরুর উৎসবে। এই ইচ্ছের রূপায়ণ হিসাবে অন্যসব সভ্যতার মতো বাংলায় প্রচলিত হয় বাংলা সন বা বর্ষ।

নিরস সময়ের হিসাব নিতে গেলে দেখা যায়, নববর্ষের উৎসব অনুষ্ঠান সভ্যতা-সাংস্কৃতির বিচারক যথেষ্ট প্রাচীন। নানা নিদর্শন থেকে অনুমান করা চলে। শুরুতে এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল প্রকৃতি উপাসক, কৃষিজীবী, নানা ধরনের আচার অনুষ্ঠান। পরে এক সময় ধর্মাচরণের প্রভাবও এতে পড়েছে। এসেছে উৎপাদন-সম্পর্কের প্রভাব। বিশেষত কৃষি নির্ভর জনগোষ্ঠির জীবনাচরণ ঘিরে।

বাংলা সনের প্রবর্তক হিসাবে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ এবং মোগল সম্রাট আকবর এর নাম শোনা যায়। আকবরের সিংহাসনের আরোহনের পর থেকে বঙ্গাব্দ (তারিখ-ইলাহী) প্রচলন করা হয়। সেই থেকে সারা বাংলায় উদযাপিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষের মতো ঐতিহ্যবাহী উৎসব।

বৈশাখ আসে সদম্ভ পায়ে বিস্ফোরিত চোখ, ত্বরিত তিলক আঁকা, উদ্দাম পেশী, বিস্তৃত বক্ষদেশ, যেন এক জটধারী যুবা সন্ন্যাসী, সঙ্গে শত সেবা দাসী, অন্তঃসত্বা মেঘ-গোপিনীরা। বৈশাখ কখনো বিদ্রোহী ‘ঘনশ্যাম’ বিক্ষুদ্ধ নকীব, তাই তার অন্য পরিচয় ‘কাল বৈশাখী’। ওই কালবৈশাখীর মরণ ছোবল যেনেও এই এলাকায় মানুষেরা শুভ নববর্ষকে বরণ করে নেয় আপন তাগিদে। তাইতো কবি গুরুর গান গীত হয় ‘এসো হে বৈশাখ এসো’।

গ্রাম এলাকার মানুষেরা এই দিনটিকে বরণ করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। বৈশাখ এলে গ্রামীণ চিত্র যায় পাল্টে, খাঁ খাঁ মাঠে এক মাথা তাল, প্রান্তরে বট কিংবা মানুষের সাধ্যমত ঘর বাড়ি সচকিত হয়ে উঠে। বনে বনে আন্দোলন, কী জানি কখন ক্ষেপে যায় বৈশাখ।

বৈশাখের আগমনে নয়া পানি আসে নদীতে ঋতুবতী হয় মরাগাঙ, মাছেরা সতেজ হয়। ধানের সবুজে চলে বাতাসের মৈথুন, গর্ভে শীষের নড়াচড়া, মাঠে মাঠে বেশ কিছু বীজের প্রসব শুরু হয় এ মাসেই।

ঈশান বাসরে গর্ভিনী মেঘ দেখে মাটিতে ঘাস বুক টান করে দাঁড়াবেই। দুরন্ত কিশোর খাওয়া-দাওয়া ভুলে কাঁচ গুড়ো আঠা মেশানো কাঁটা ঘুড়ির লাটাই নিয়ে দৌঁড়াবে শ্যামল মাঠে। শত ঘুড়ির মেলা বসবে বৈশাখের আকাশে। এটাই বৈশাখের চিত্র।

এই অঞ্চলের মানুষজন আগেরকার দিনে পহেলা বৈশাখ কে বরণ করতে সকাল হতে গোসল করে পবিত্র হতেন। শুধু নিজেরা নয়, বাড়ির গবাদি পশুদের নদী, খাল-বিলে সাঁতার কাটিয়ে নেয়া হতো। গবাদি পশুদের খাওয়ানো হতো কঁচি ঘাস, নীমপাতা, বাঁশ পাতা, হলুদ, সরিষার তেল দিয়ে বানানো বিশেষ দাওয়া। দুধের গাভীর জন্য ভাতের মাড়, স্বর্ণালতার লতা। নিজেদের জন্য রান্না হতো বিশেষ উন্নত খাবার। এবং কেও কেও ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘বকনি ভাত’ রান্না করে বাড়ির সবাইকে খাওয়াতো। এই বকনি ভাত রান্নার নিয়ম ছিলো অন্য রকম। আউস ধান পানিতে ভিজিয়ে রেখে অংকুরিত করা হতো। পরে ওই ধান রোদে শুকিয়ে তারপর ঢেঁকিতে ছেঁটে এক ধরনের বিশেষ চাল তৈরি করা হতো। ওই চাল থেকে ভাত রান্না করে, রাতে পান্তা বানিয়ে পরে সকালে খাওয়া হতো। ভাতে এক ধরনের মাদকতার মতো স্বাদ ছিল। এই ভাতের কল্যাণে নাকি কৃষক পরিবারে সারা বছরের ভলো ফসল প্রাপ্তির মনোবাসনা পূর্ণ হয় বলে লোকবিশ্বাস ছিল। আরো পূর্ণ করার জন্য মাজারে দরগায় বা বড় বটবৃক্ষ, তেতুল গাছের নীচে মোমবাতি আগরবাতি এবং ‘ছিন্নি’ বিতরণ করে আসতো। কেও কেও সিঁদুর ফোটা দিতো। তাদের বিশ্বাসটি হলো এই দিন ভালো গেলে সারা বৎসর ভালো যাবে।

এই দিনে বাজার-নদীঘাটে এবং কোন কোন খোলা মাঠে মেলার আয়োজন হতো। মেলায় আগমন করতো হিন্দু, মুসলমান সকলে সবাই যেন এক পরিবারের মানুষ। প্রাচীন কবি বিদ্যাপতি ঠাকুর তার ‘অবহটঠ’ কাব্যে মেলা সম্পর্কে বলেছেন : এ হচ্ছে সেই জায়গা, যেখানে ব্রাহ্মনের পৈতে গিয়ে পড়েছে চন্ডালের গায়ে, আর বেশ্যার পয়োধর মর্দিত হচ্ছে সন্ন্যাসীর বুকে’।

ওই সব বৈশাখী মেলায় ছোট ছোট নানা ধরনের দোকান বসতো, খেলনা, মাটির বাসন কোসন, কাঠের আসবাবপত্র, লোহার কৃষি সরঞ্জামাদি, বাঁশের ডালা, কুলো, বেতের গৃহসামগ্রী, খাবারের দোকান ভরে থাকতো লোকায়ত খাবার, মুড়ি ,মুড়কি, খাজা, সাজ, জিলাপী, কদমা, রসগোল্লা ইত্যাদি। নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী মাটির হাড়ি ভর্তি মিষ্টিজাত জিনিস কিনে মেলা শেষে বাড়ি ফিরতো। এ যেন চিরায়িত আবহমান বাংলার এক চিরচেনা দৃশ্যপট।

মেলায় কৃষি সরঞ্জামাদি বিক্রি হতো প্রচুর। সারা বৎসরের লাঙ্গল, জোয়াল, মই, কাচি, পাচুন, কোদাল, কোড়াল, দা, খন্তি, এবং বিভিন্ন ধরনের ধান, যব, কাউন এবং বিভিন্ন ফসল ও সবজির বীজ। আমি বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় ঘুরে দেখেছি, এখানে মূলত মাছের মেলা। সারাদেশ থেকে প্রচুর বড় বড় মাছ আমাদানী হয়। এই অঞ্চলের মানুষজন সারা বছরে বড় বড় মাছ কেনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। মাছের সাথে পান খাওয়ার ঝিনুকের চুন ও কেশর আলুর (শাখ আলু) বীজের জন্য বিখ্যাত। এই মেলা ছাড়া ওই অঞ্চলে কেশর আলুর বীজ পাওয়া দুস্কর। তাই সারা দেশের কেশর আলু চাষিরা এখানে এনে বীজ ক্রয় করে।

এই অঞ্চলের বৈশাখী মেলা ছাড়াও জামালপুর অঞ্চলে মাদারগঞ্জের বালিজুড়ি সন্ন্যাসী মেলা অনুষ্ঠিত হতো। প্রাচীনকাল থেকে বালিজুড়ি বাজরের পশ্চিম পাশে একটি দহ (বিল) ছিলো যার কিছুটা এখনো বিদ্যমান। এই স্থানে কয়েকটি বিশাল বড় অশ্বথ গাছ ছিল তার পাশে একটি ছোট মন্দির। ওই মন্দিরে সন্ন্যাসী পূজা উপলক্ষে এখানে একটি মেলা বসতো। মেলাটি ছিলো ভারতবর্ষের মধ্যে সন্ন্যাসীদের মিলনমেলা । ১৭শ খ্রিষ্টাদ্বে উত্তরাঞ্চলে সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ চলছিলো। তখন ওই অঞ্চলের এক চেটিয়া সন্ন্যাাসীদের দখলে ছিল। সন্ন্যাসীরা যমুনার চরাঞ্চলের ঘাটি করে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। তখনি তারা বগুড়া জেলার গাবতলী মহিষাবান এর গোলাবড়ি (এখানে নৌবন্দর ছিলো) এলাকায় গাড়িদহ নদীর পাড়ে বটতলায় একটি মন্দির স্থাপন করেন এবং সন্ন্যাসী পূজা করতেন। ওই সময়েই তারা মাদারগঞ্জ এলাকায় গমণ করেন এবং বালিজুড়ি দহ পাড়া এলাকায় বিলের ধারে একটি মন্দির স্থাপন করেন। এবং দুটি মন্দিরেই তারা সন্যাসী পূজা ও মেলার আয়োজন করতো। এসব মন্দিরে জমায়েতের মধ্যে দিয়ে তারা তারা দল বেঁধে জামালপুর (সন্ন্যাাসীগঞ্জ নামে পরিচিত ছিলো) দয়াময়ী মন্দিরে এসে বাৎসরিক স্নানোৎসবে মিলিত হতো। এই মেলা ছিল খুবই জমজমাট। কয়েকশ বছর মেলাটি চলার পর সাম্প্রদায়িক সংর্ঘর্ষের কারনে বন্ধ হয়ে যায়। এবং মন্দির ভেঙ্গে সেখানে চাষবাস শুরু করে স্থানীয়রা। বর্তমানে এই বিলের কিছু অংশ এখনো টিকে আছে। পরে ঐ মেলার আদলে তার পাশে ইসলামি ঈদ মেলার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় পৌনে দুশ বছর ধরে বালিজুড়ি ঈদ মেলা চলে আসছে। প্রতিবছর ঈদ উল ফিতরের দিন থেকে ৩ বা ৫ দিন ব্যাপী এই মেলা চলে। এ রকমের মেলা দেশের কোথাও নেই বলে জানা গেছে।

ঈদ উপলক্ষে এক মাত্র মাদারগঞ্জেই এই মেলা অনুষ্টিত হয়। মেলায় কৃষি পণ্য, মাটির জিনিস, টেপা পুতুল, মৃৎ শিল্পের বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী, বাঁশ ও বেতের সাংসারিক জিনিস, কামাদের নানান লোহা সামগ্রী, কাঠের লাঙ্গল, লাঙলের বিভিন্ন উপকরণ, বীজ, প্লাষ্টিক খেলনা, মেয়েদের চুড়ি, ফিতা , আলতা, কসমেটিক সামগ্রী, কাগজ ও শোলার বিভিন্ন খেলনা,ইদানিং কাঠের আসবাবপত্র মেলায় পাওয়া যায়। তার সাথে নাগরদোলা শিশুদের বাড়তি পাওনা। মেলায় সবচেয়ে বেশী দোকান উঠে লোক খাবার ও মিষ্টির। মেলার পাশে একটি গ্রামে যুগ যুগ ধরে কারিগররা হাতের নৈপণ্যে জিলাপী,গজা, বাতাসা, সাজ, মুড়কি,মোয়া, বুন্দিয়া, রং বে রং এর মিস্টির থালার সাজেয়ে রেখে দেয়। এই ঐতিহ্যবাহি মেলায় সব চেয়ে বেশী বিক্রি হয় মিস্টি জাতীয় জিনিসের। এই মেলা ছাড়াও জামালপুরের দয়াময়ী মন্দিরের বার্ষিক স্নানোৎসবের অষ্টমী মেলাটিও খুবই প্রাচীন। কারন দয়াময়ী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে। তার পর থেকেই এই অষ্টমী মেলা চলে আসছে। ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও ভারত থেকেও লোক সমাগম হয়। মেলাটি বর্তমানে শহরের একটি রাস্তায় সীমাবদ্ধ থাকলেও এককালে কালে সারা শহরে ছড়িয়ে ছিলো।

মেলান্দহের দুরমুটে হযরত শাহ কামাল (রহ:) এর মাজারে বহুদিন থেকে বৈশাখের প্রথম দিনে থেকে এক মাস ব্যাপী মেলা চলে। সারা দেশ থেকে পীরভক্ত ও তরিকাপন্থী লোকজন মেলায় আসে। এই মেলাটি ইদানিংকালে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। মেলায় দুরদুরান্ত থেকে তরিকাপন্থী এক শ্রেনীর পাগল সম্প্রদায় বছরের একবার ওই মেলায় মিলিত হয়। এছাড়া জামালপুর সদরের ঘোড়াধাপ ইউনয়নের গোপালপুর বাজারে ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলা প্রসিদ্ধ। ১৮শ এর দশক থেকে বারুণী স্নান উপলক্ষে বট বৃক্ষের নীচে এই মেলার গোড়াপত্তন হয়। মেলাটিকে চৈত্রমেলা বলা হতো। মেলাটিকে পরবর্ত্তীতে ইসলামী মেলার নামকরণ হয়। পরে এই মেলা জামাই মেলা হিসাবে পরিচয় লাভ করে। মেলায় প্রচুর লোকের আগমন ঘটে। এবং এই অঞ্চলে জামাইদের মিলন মেলায় পরিনিত হয়। মেলায় মিষ্টি, মিঠাই লোক খাবার যেমন, জিলাপী, গজা, সাজ, মুড়কী, বুন্দিয়া, বিন্নি ধানের খই,এবং মাটির খেলনা তৈজসপত্র, সাংসারিক জিনিস, কৃষি সরঞ্জামাদী, প্লাস্টিক,বাঁশ এবং কাঠের কৃষি ও আসবাবপত্র পাওয়া যায়।

জেলার সরিষাবাড়ির মহাদান ইউনিয়নের খাগুরিয়া গ্রামে কালীমাতার বার্ষিক পূজা উপলক্ষে প্রায় শত বছর ধরে একটি মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেলায় ভারতসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভক্তরা মেলায় আগমন করেন। মেলা সর্ম্পকে জানা যায় যে, শত বছর আগে এখানে জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতো। তারা পামের ঝিনাই নদীতে নৌকা নিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহী করতো। কয়েকজন জেলে মাছ ধরার সময় একদিন তাদের জালে দুটি মুর্ত্তি পায়। ওই মুর্ত্তি দুটি তারা বাড়িতে এনে পাটের শোলা দিয়ে মন্দির বানিয়ে পূজা দিতে শুরু করে। পরে ঐ এলাকার যধিষ্ঠির মন্ডল নামের একজন ধন্যাঢ্য ব্যাক্তি এই মন্দিরটি নির্মান করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিবছর শীত মৌসুমে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ মেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশী হাজার হাজার মুসলমান লোকজনের সমাগম ঘটে।

এইসব মেলা ছাড়াও জামালপুরের সরকারীভাবে অনুষ্ঠিত প্রাচীন এক মেলার ইতিহাস রয়েছে। সেটি জামালপুর পাবলিক মেলা হিসাবে সবাই চেনে। বর্তমানে স্টেডিয়াম ও জেলা পুলিশ অফিসসহ বিস্তৃত এলাকায় এই মেলার স্থান ছিলো। আদিকাল থেকেই কৃষি প্রধান এই জেলায় ব্যাপক কৃষি পণ্য উৎপাদিত হতো। ১৯০৩ সালে উন্নত কৃষির ঢেও লাগে এই জামালপুরে। এই এলাকায় ১৭৯৭ সালে আলু ও ১৮০৬ সালে নীলচাষ শুরু করে। পরে এবং ১৮৭২ সালে তুলার চাষ শুরু হয়। সকল ফসলে ভরপুর এই জামালপুরে একটি কৃষি প্রদর্শনী করার তাগদা আসে । মহুকুমা শহরে ১৮৮৬ সালে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট নন্দন কুমার বসু এই পাবলিক মেলার আয়োজন করেন। মেলায় কৃষি পণ্যসহ জামালপুরের চরাঞ্চলের প্রচুর গবাদী পশুসহ সাারদেশের উন্নত গরু, গাভী, ভারত থেকে মহিষ .ঘোড়া,উন্নত ছাগল, উট,দুম্বা পর্যন্ত বিক্রি হতো। এই মেলায় বিক্রয় হয়। সারা ভারতবর্ষে মেলার নাম ছড়িয়ে পড়ে। একটানা মেলা চলে ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত। মাঝখানে ১৯০৭ সালে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গার কারণে মেলা বসতে পারেনি। এই ভয়াবহ দাঙ্গার কারন হিসাবে পাবলিক মেলা কে দায়ী করা হয়। কেনা বেচার সাথে এই মেলাটি ছিলো এই অঞ্চলের চিত্তবিনোদনের একটি স্থান। মেলায় বিনোদনের জন্য কলকাতা থেকে স্টার ও মিণার্ভা থিয়েটার নিয়ে আসা হতো। দি গ্রেট আসাম বেঙ্গল সার্কাস ও চাইনিজ সার্কাস দলও আগমন করতো। মেলাটি বছরে চার মাস অনুষ্ঠিত হতো। সম্প্রতিকালে জেলা শহরে দয়াময়ী মন্দিরের পাশে একটি খোলা মাঠে পৌরসভার উদ্দোগে প্রতিবছর বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু দু বছর থেকে এই মাঠটি সাংস্কৃতিক পল্লীর জন্য বরাদ্দ নেয়ায় মেলাটি বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া সরিষাবাড়ি ও মাদারগঞ্জেও ইদানিং সরকারী ব্যবস্থাপনায় মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এই মেলাগুলিতে লোকায়ত জীবন যাপন এবং লোকায়িত ভাব, জ্ঞান ও আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে পরিবেশন এবং প্রাণ বৈচিত্র (Biodiversity) সংরক্ষণ ও বিকাশের ব্যাপারটা ও তপ্রোতভাবে জড়িত ছিল গানের আসর। মেলা ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় জারি, সারি, মুর্শিদি ও পালা গানের আসর বসতো। বৈশাখী উৎসবে বিভিন্ন খেলাধুলাও হতো। ষাড় দৌড়, মই দৌড় ষাড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদির প্রতিযোগীতা ছিলো।।

বৈশাখের প্রধান বিষয় ছিল ‘হালখাতা’ সারা বছরের বাকী লেনদেন মিটিয়ে ফেলার জন্য ওই দিনটিতে দোকানীরা দোকান ঘর সাজিয়ে নিদির্ষ্ট গ্রাহকদের দাওয়াত দিতো, গ্রাহকরা তাদের বাকী মিটিয়ে মিষ্টি মুখ করে বাড়ি ফিরতো। এখনো সে রেওয়াজ রয়ে গেছে।

আগেকার আমলে জমিদাররা তাদের বাড়িতে পূন্যাহ অনুষ্ঠানে আয়োজন করতো। তালুকদার,মহজনরা জমিদারের কাছে বছরের খাজনা মিটিয়ে আবার জমি ইজারা নিতো।

বৈশাখী উৎসবের এই রূপ এখন পাল্টে গেছে, আধুনিক রূপে মেলা অপসাংস্কৃতির হোতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাত্রার নামে অশালীন নাচ আর মেলার নামে জুয়া খেলা এই রূপে মেলাকে চিনে এখনকার মানুষরা। কিন্তু উৎসব বা মেলার ভাবগত অর্থ মহা মানবতার আত্মিক সম্মিলন। আবহমান বাংলার মেলা শুধুমাত্র পণ্য প্রদর্শনী নয়, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের আধ্যাত্মিক মিলন। প্রানের সঙ্গে প্রানের একাত্মতা।

মেলার সঙ্গে সম্পর্কিত পারমার্থিক দিক ঋতুবৈশিষ্ট্য উদযাপনের তাগিদ, সাধক পুরষের আবির্ভাব বা তিরোধান পূন্যতিথি যোগ। মেলা মানে ইন্সার সাধন, মনোবাসনা পৃত্তির উদযোগ, সন্তান কামনা, রোগমুক্তির ব্যাকুলতা। আবার মেলা মানে উৎপাদন প্রক্রিয়ার চালচিত্র। মেলার পণ্যের আদান-প্রদানের সাথে থাকে নিরক্ষর ও লোকায়ত জগতের ভাবের আদান-প্রদান ও মেল-বন্ধন। মেলা মানে মানুষ দিয়ে মানুষ ধরার ফাঁদ।