ধর্মের সাথে সংস্কৃতির কোন বিরোধ নেই : প্রধানমন্ত্রী

বাংলারচিঠিডটকম ডেস্ক ❑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ১ বৈশাখ উদযাপনের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির কোন সংঘাত বা বিরোধ নেই।

তিনি বলেন, ‘ কিছু লোক ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধ সৃষ্টি করতে চায়। এটা মোটেও সঠিক নয়। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। আমরা একসঙ্গে উৎসব পালন করে থাকি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে ৮টি জেলায় নবনির্মিত শিল্পকলা একাডেমি ভবনের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথি’র ভাষণে এ সব কথা বলেন।

তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।

কুষ্টিয়া,খুলনা, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও রংপুর জেলার নবনির্মিত শিল্পকলা একাডেমিগুলোওে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিল।

বক্তৃতার প্রারম্ভে প্রধানমন্ত্রী দেশে এবং বিদেশে অবস্থানকারি সকল বাংলাদেশীদের পবিত্র মাহে রমজান, আগামীকালের বাংলা নববর্ষ এবং আসন্ন ঈদুর ফিতরের আগাম শুভেচ্ছা জানান।

বাংলা ১৪০০ সালে বাঙালির বর্ষবরণ ১ বৈশাখ উদযাপনে বারবার বাধা দেয়া এবং রমনা রটমূলে বোমা হামলার প্রসঙ্গ স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এগুলো করাই হয়েছিল যাতে করে আমাদের সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। আজ আমরা ১ বৈশাখ উদযাপন করি। এই একটা উৎসব ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এক হয়ে এক সঙ্গে উদযাপন করে। যেখানে সকলের একটা চমৎকার মিলনমেলা হয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের যেখানেই বাংলাদেশীরা আছে তারাই এই উৎসব পালন করে যাচ্ছে।

তিনি করোনার জন্য সতর্কতার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাঙালির প্রাণের উৎসব ১ বৈশাখ উদযাপনের আহ্বান জানান।

সরকার প্রধান বলেন, ‘আমাদের এই ঐতিহ্য আমাদেরকেই ধারণ করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন এটা চর্চা করতে পারে, বিকশিত করতে পারে এবং আধুনিক প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটিয়ে যেন এটার আরো উৎকর্র্ষ সাধণ করতে পারে সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। সেটা আমরা দিব।’

প্রধানমন্ত্রী আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সকল ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থানের কথা উল্লেখ করে বলেন, কেবল সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম চর্চা নয় দেশের যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে তাদেরও সংস্কৃতি চর্চা বিকাশের ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে।

তিনি বলেন, এগুলো আবহমানকাল থেকেই আমাদের দেশের চলে আসছে, এগুলোর দিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। যে গুলো আমরা ভূলবোনা। তবে, সামনে এগিয়ে আধুনিক সংস্কৃতিকেও আমরা রপ্ত করবো।

অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর বক্তৃতা করেন এবং বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী স্বাগত বক্তব্য দেন।

অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত নবনির্মিত ৮টি শিল্ককলা একাডেমি ভবনের ওপর একটি তথ্যচিত্রও অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, আমরা বাঙালি আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা এবং যে সংস্কৃতি রয়েছে সেটা যেন আরো উজ্জীবিত এবং বিকশিত হয় সেভাবেই কাজ করতে হবে।

আমাদের দেশের মানুষরা সাধারণত সংস্কৃিতমনা উল্লেখ করে তিনি উদাহারণ টানেন- আমাদের দেশে নৌকার মাঝিও নৌকা চালাতে চালাতে গান ধরে, এক সময়ে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল এবং সে সময়ে মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ গানের সুর আজও হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আধুনিক যুগে সে সব হারিয়ে যেতে বসেছে তবুও সেগুলো শিল্পীর শিল্পে উজ্জীবিত হয়ে রয়েছে। কাজেই আমাদের এই সাংস্কৃতিক চর্চাগুলো অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ঐতিহ্য যেমন আমরা ভূলবোনা আবার যুগের সাথে তাল মিলিয়েও চলতে হবে। আধুনিক যুগের যে সংস্কৃতি তার সঙ্গে যেন আমাদের ছেলে-মেয়েরা তাল মিলিয়ে চলতে পারে বা সেই সংস্কৃতিও যেন রপ্ত করতে বা চর্চা করতে পারে সেজন্য আমাদের ঐতিহের সাথে আধুনিক প্রযুক্তি এবং আধুনিক জ্ঞান অর্জন করাও একান্তভাবে দরকার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু। ভাষা সংগ্রামের পথ ধরে বহু ত্যাগ-তিতীক্ষার মধ্যদিয়েই এই অর্জন।

’৭৫ এ জাতির পিতাকে হত্যার পর এদেশে শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে যে স্থবিরতা নেমে এসেছিল তার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একুশ বছর পর ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে তা হচ্ছে অপসংস্কৃতি ও জঙ্গিবাদ রোধকরণ এবং নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রচার ও প্রসারে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করি।

তিনি বলেন, ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে সংস্কৃতি খাতের উন্নয়নে ১৮৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নিই। যার মধ্যে ৩৬ টি জেলায় ও ৬ টি থানায়, জেলা শিল্পকলা একাডেমি স্থাপন, সম্প্রসারণ ও সংস্কারের কাজ করি। ৯ টি জেলায় নতুন পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপন করি।

সরকার প্রধান বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আধুনিকীকরণ, নওগাঁর পতিসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাচারী বাড়ী জাদুঘরে রূপান্তর এবং খুলনার দক্ষিণ ডিহিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বাড়ি, শাহজাদপুরে কাচারী বাড়ি ও শিলাইদহে কুঠি বাড়ি সংস্কার করেছি।

তিনি বলেন, পল্লী কবি জসীম উদদীনের ফরিদপুরের বাসভবনে জাদুঘর, লাইব্রেরি-কাম-গবেষণা কেন্দ্র, উন্মুক্ত মঞ্চ নির্মাণ এবং বাংলা একাডেমিতে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর ও লেখক জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম বর্তমানে ৬৪ জেলার সীমা ছাড়িয়ে ৪৯৩ উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত। ইতোমধ্যে হালুয়াঘাট, নওগাঁ ও দিনাজপুরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমি নির্মাণ করেছি। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় সিনেমা হলের সঙ্গে সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ রেখেছি। তিনি এ সময় দেশের তৃণমূলের মানুষের অন্যতম শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম সিনেমা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা এবং আরো উন্নত করা জরুরী বলে অভিমত দেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের শিল্পের বিকাশ হবে চতুর্মুখী, সেটাই আমরা চাই। পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা বা এলাকা ভিত্তিক সংস্কৃতিরও বিকাশ ঘটাতে হবে। লোকজ সঙ্গীত এবং লোকজ সাহিত্য যাতে আরো ভালভাবে বিকশিত হতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ, অঞ্চল ভিত্তিক পালাগান, কবিগান, যাত্রা এ সব লোক ঐতিহ্য আমাদের অমূল্য সম্পদ।

তিনি বলেন, ৪৯৩টি উপজেলায় পর্যায়ক্রমে কালচারাল কমপ্লেক্স স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে প্রত্যেক উপজেলার ছেলে-মেয়েরাই তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ পায়। আমাদের ছেলে-মেয়েরা মেধাবী এবং মেধা বিকাশের সুযোগ করে দেয়া গেলে তারা অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে দেশকে প্রগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।