মোমিনুরে উদ্দীপিত শেরপুর জেলা প্রশাসন

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

শেরপুরে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নতুন যোগদান করেছেন মোহাম্মদ মোমিনুর রশীদ। মুক্তিযোদ্ধা, সমাজকর্মী ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা বলছেন, তিনি যোগদান করার পর জেলা প্রশাসনের কাজে এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউন বাস্তবায়নে স্বশরীরে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতি, করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া গরীব অসহায় ও হতদরিদ্রদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, ৭১’ এ যুদ্ধ ও গণহত্যায় শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহতদের পরিবারবর্গ ও বিরাঙ্গণাদের মাঝে ঈদ উপহার বিতরণ, নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারের চলমান প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিনিয়ত মাঠ পর্যায়ে তদারকির বিষয়গুলো জেলাবাসীর দৃষ্টি কেড়েছে।

যুদ্ধাহতদের পরিবারবর্গ ও বিরাঙ্গণাদের মাঝে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ঈদ উপহার বিতরণের বিষয়টির প্রশংসা করে জেলা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আখতারুজ্জামান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতি জেলায় এখন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়নি। ৭ ডিসেম্বর শেরপুর মুক্ত দিবস। ওই দিন মিত্র বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলের কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরা শহরের দারোগ আলী পৌর পার্কে অবতরণ করে স্বাধীনতার পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন। ৭১’ এর ২৩ মার্চ শেরপুরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর কার্যালয় ছিল শহরের বটতলা এলাকার ডরমেটরি ভবনের পাশে। সেখানে আসতেন মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন কুমার এবং ইপিআর সুবেদাররা। তাদের মাধ্যমে সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মীরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যান।

এছাড়া ঝিনাইগাতীর আহমেদ নগরের টর্চার সেল, শ্রীবরদীর জগতপুরের গণকবর, শেরপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশের গণকবর এবং ৬৯’এর গণআন্দোলনে শহীদ ছাত্র নেতা দারোগ আলীর স্মৃতি ধরে রাখতে সরকারিভাবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

রেল লাইন স্থাপন শেরপুরবাসীর প্রাণের দাবি। আর এ বিষয়ে সরকারের ঘোষনাও রয়েছে উল্লেখ করে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম হিরো বলেন, মোমিনুর রশীদ সাহেব শেরপুরে যোগদানের পর জেলার উন্নয়নে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। যা অত্যন্ত আনন্দের। তাই রেল লাইন স্থাপনের বিষয়টি আরও গতিশীল করতে জেলা প্রশাসকের কাছে আহ্বান জানান তিনি।

এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এগ্রিকালচার ইনিস্টিটিউটের (এটিআই) নামে ৬২ একর জমি ছিল। মানুষের দখল দারিত্বের কারণে এখন মাত্র ৩২ একর জমি সরেজমিনে রয়েছে। ওই জমিতে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন জরুরি বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া জেলায় মেডিকেল কলেজ ও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

ডায়াবেটিক সমিতি ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের জেলা সভানেত্রী রাজিয়া সামাদ ডালিয়া বলেন, বর্তমান সময়ে করোনা পরিস্থিতি জেলায় মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে সেই সাথে বাড়ছে মৃত্যুর হার। অন্যদিকে লকডাউন থাকায় বন্ধ রয়েছে দোকানপাট। এ কারণে অর্থনীতির চাকা মন্থর গতিতে চলে এসেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা চান তিনি।

ডালিয়া বলেন, জেলার প্রতিটি ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে ক্যাম্পেইন করে ঘরে ঘরে করোনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। সেই সাথে প্রত্যেকের জন্য করোনা টিকা নিশ্চিত করা গেলে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার যেমন কমবে তেমনি সচল হতে পারে অর্থনীতির চাকা।

শেরপুর পুলিশ লাইন্স একাডেমি ফর ক্রিয়েটিভ এডুকেশন’র প্রধান শিক্ষক ও নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমান জেলা প্রশাসক যোগদান করার পর জেলা প্রশাসনের কাজে এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় প্রতিটি কাজেই তিনি ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করেন।

তিনি আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া হরিজন পল্লীর মানুষের জন্য সহায়তা চেয়ে সদর ইউএনও’র মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে সম্প্রতি একটি লিখিত আবেদন জানাই। ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে জেলা প্রশাসক দ্রুত সহায়তা প্রদান করেন।

জেলা সদর হাসপাতালে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য জন প্রতি ১০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষক কালাম বলেন, হতদরিদ্রদের পক্ষে এই অর্থ পরিশোধ করে করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব না। তাই প্রত্যেককে করোনা পরীক্ষার আওতায় আনতে ওই ফি মওকুফ করার ব্যবস্থা গ্রহণে জেলা প্রশাসকের কাছে আর্জি জানান তিনি।

জেলার নকলায় ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে ইছামতি নদীর গর্ভে বিলীন হওয়ার হুমকির মুখে পড়ে পিছলাকুড়ি-তাড়াকান্দা সড়ক। সড়কটি উপজেলার উত্তরাঞ্চলের জন্য বেড়ি বাঁধ হিসেবে গণ্য।

চলতি মাসের ৩ জুলাই সকালে ছবিসহ বিভিন্ন তথ্য নকলার মোশারফ হোসেন নামে একজন গণমাধ্যমকর্মী ফেসবুকে শেয়ার করেন। এর পরপরই ওই দিন বিকালে জেলা প্রশাসক ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। সেই সাথে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় দিক নিদের্শনা দেন তিনি।

৫ জুলাই জেলা সদর হাসপাতাল পরিদর্শন। ৭ জুলাই সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর প্রকল্প পরিদর্শন। ৮ জুলাই একই উপজেলার সিংগাবরুনা ইউনিয়নে কর্ণঝোড়া নদীর ওপর নির্মিত মাটিফাটা ব্রিজ সংলগ্ন এপ্রোচ রোড ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন। ৯ জুলাই সদর উপজেলার চরপক্ষীমারী ইউনিয়নের চুনিয়ার চর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙ্গন পরিদর্শন। ১২ জুলাই সদর উপজেলার গাজীর খামার বাজারে জনসাধারণের মধ্যে কোভিড সচেতনতা ও মাস্ক বিতরণ। ১৭ জুলাই শেরপুর স্টেডিয়ামে ২০০ জন দুস্থ ও অসহায় ব্যক্তির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা প্রদান। ১৮ জুলাই করোনায় আক্রান্ত শ্রীবরদীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতাউর রহমানকে স্বশরীরে দেখতে যান জেলা প্রশাসক।

করোনা প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত ফেসবুক পেজ ডিসি শেরপুরে বিভিন্ন পরামর্শ ও সচেতনেতামূলক পোস্ট শেয়ার করা হয়। ওই পেজের কমেন্ট অপশনে অনেকেই তাদের মতামত তুলে ধরেন।

সেখানে মমিনুল ইসলাম নামে একজন লেখেন, যোগ্য অধিনায়কের কাজটি করেছেন স্যার, অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে, সেই সাথে এসিল্যান্ড স্যারের সুস্থতা কামনা করছি।

তানিমা আফ্রাদ নামে একজন লেখেন, একজন জুনিয়রের প্রতি আপনার ভালবাসা দেখে সত্যিই অভিভূত আমরা। আপনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, যেভাবে একজন জুনিয়র অফিসারের পাশে দাঁড়ালেন, এটা ভুলার মত নয়।

হাফিজুর রহমান নামে একজন লেখেন, আমার যদি ভুল না হয়, আমার দেখা মতে হয়তো আপনিই হবেন শেরপুর জেলার সেরা ডিসি। ইতিমধ্যে আপনি শেরপুরবাসীর অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন।

জেলা প্রশাসনের সকল সেবা সকলের জন্য উন্মুক্ত করতে চান উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ বলেন, কোন কাজের জন্য যাতে কাউকে আমার দপ্তরে না আসতে হয়, আমি সে চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে ভূমি সেবাসহ সকল সেবা অনলাইন ও অটোমেশন করার উদ্যোগ নিয়েছি। একে একে প্রতিটি পরিসেবা ডিজিটাল ও অটোমেশন করতে চাই।

প্রসঙ্গত, মোমিনুর রশীদ গেল মাসের ২১ জুন নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি এর আগে ঢাকা জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২২তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের এই কর্মকর্তা শিক্ষা জীবনে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এসএসসি থেকে মাস্টার ডিগ্রি পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ অর্জন করেন। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরেস্ট্রিতে অনার্স এবং মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। নিয়েছেন দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ। নাগরিক সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পুরস্কার।