আন্দোলনে চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত, ওসির প্রত্যাহার চায় চিকিৎসকরা

চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করছে রোগী ও রোগীর স্বজনরা। ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
বাংলারচিঠিডটকম

চারদফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জামালপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসকদের কর্মবিরতি লাগাতার চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন জামালপুর জেলা শাখা। ২৮ ডিসেম্বর বিকেলে জামালপুর সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ ঘোষণা দেন সংগঠন দুটির নেতৃবৃন্দ।

একজন নারী রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জামালপুর সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে হামলা, ভাংচুর, দু’জন চিকিৎসক ও চারজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৬ ডিসেম্বর থেকে সদর হাসপাতালসহ জেলার সকল উপজেলা হাসপাতালে লাগাতার বহির্বিভাগ ও বেসরকারি ক্লিনিকে কর্মবিরতি পালন শুরু করেছেন চিকিৎসকরা। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ব্যাপক ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।

২৮ ডিসেম্বর বিকেলে জামালপুর সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে উন্মুক্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ জেলা শাখার আহ্বায়ক চিকিৎসক মোশায়ের উল ইসলাম রতন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে হামলা, ভাংচুর ও একজন চিকিৎসকসহ চারজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে নির্যাতন এবং ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের হামলার সময় সদরের ইউএইচএফপিও চিকিৎসক লুৎফর রহমানের ওপর পুলিশি নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এ ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এ ঘটনায় গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গত ২৪ ঘন্টার মধ্যেও তাদের তদন্ত প্রতিবেদন না দেওয়ায় এ নিয়েও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

পরে তিনি সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি চারদফা দাবি তুলে ধরে বলেন, আমরা কর্মবিরতি দিয়ে সাধারণ রোগীদের ভোগান্তি বাড়াতে চাই না। তাই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী ও প্রসূতিদের জরুরি সেবা কার্যক্রম চালু রেখেছি। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও বাইরে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি লাগাতার চলমান থাকবে।

দাবিগুলো হলো- হাসপাতালে হামলার সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে সদরের ইউএইচএফপিও চিকিৎসক লুৎফর রহমানের ওপর সদর থানার ওসিসহ যে সকল পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য অমানবিক নির্যাতন করেছে তাদের সকলকে এই জেলা থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। হামলা-ভাংচুর ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তা চিকিৎসক চিরঞ্জীব সরকারকে নির্যাতনের ঘটনার সাথে জড়িত বহিরাগত সকলকে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। জামালপুর সদর হাসপাতালের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করতে হবে এবং দীর্ঘদিনের দাবি সারাদেশের চিকিৎসকদের নিরাপত্তার সার্থে চিকিৎসক সুরক্ষা আইন দ্রুত পাশ করতে হবে।

জেলা প্রশাসন গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মোকলেসুর রহমান তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে পূর্বনির্ধারিত সময় ২৭ ডিসেম্বর রাত ৮টার মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশে রহস্যজনক কারণে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন আন্দোলনরত চিকিৎসকরা।

জামালপুর সদর হাসপাতালে হামলা, ভাংচুর ও চিকিৎসককে নির্যাতনের প্রতিবাদে চারদফা দাবি তুলে ধরেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের আহ্বায়ক চিকিৎসক মোশায়ের উল ইসলাম রতন। ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

এদিকে ২৮ ডিসেম্বর সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে সদর হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম থমকে আছে। জরুরি চিকিৎসা না পেয়ে রোগী ও রোগীর স্বজনরা ফিরে যাচ্ছেন। আন্দোলনরত চিকিৎসকরা ওয়ার্ডে ও জরুরি বিভাগে সীমিত পরিসরে জরুরি সেবাদানের কথা বললেও চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির কারণে ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের ভোগান্তি ব্যাপক বেড়েছে। জরুরি রোগীদের রেফার্ড করার জন্য সময়মতো চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেক স্বজনরা তাদের রোগীদের হাসপাতাল থেকে সরিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ময়মনসিংহ বা ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। এছাড়া হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগ, এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, সিটিস্ক্যান বিভাগ বন্ধ থাকায় রোগীদের জরুরি চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য রোগীদের হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

২৮ ডিসেম্বর দুপুরে ঝিনুক নামের সাত বছরের মেয়ের ভাঙা পা বেন্ডেজ করা অবস্থায় কোলে করে হাসপাতাল ত্যাগ করছিলেন তার বাবা দরিদ্র জামেদুল ইসলাম। তার বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার মালমারা গ্রামে। তিনি বললেন, ‘ইসলামপুর হাসপাতাল থেইকা এই হাসপাতালে পাঠাইছে আমগরে। আইজ সকালে ভর্তি করছিলাম মেয়েরে। ডাক্তার নাই দেইখা রিলিজ দিল। এহন বাড়িত নিয়া যামুগা।’

একবছর বয়সের নাতিশিশু যুবরাজের পেটের অসুখ আর বমির চিকিৎসার জন্য ২৭ ডিসেম্বর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করেছিলেন সদরের কেন্দুয়া কালিবাড়ি থেকে আসা কল্পনা বেগম। তিনি বললেন, ‘আমার নাতিরে কাইলকা ভর্তি করছিলাম। অহনো অসুখ বালা হয় নাই। কি করমু। ডাক্তর নাই তাই নিয়া গেলামগা।’

দুপুর আড়াইটার দিকে সদরের শাহবাজপুর এলাকা থেকে আসা মুমূর্ষু রোগী আব্দুল লতিফ তালুকদারকে (৭০) চিকিৎসা করাতে না পেরে স্বজনরা তাকে নিয়ে গেলেন ময়মনসিংহে। ওই রোগীর ছেলে ফরহাদ আলী তালুকদার বললেন, ‘আমার বাবার মাথায় ব্যথা। তাকে শনিবার (২৬ ডিসেম্বর) এখানে ভর্তি করি। কিন্তু কোনই চিকিৎসা করতেছে না। চিকিৎসা না করেই ওয়ার্ড থেকে রিলিজ করে দেয় নার্সরা। রেফার্ড করার মতো ডাক্তার নেই ওয়ার্ডে। অনেক বলেকয়ে রেফার্ড লিখে এখন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’

গত ২৫ ডিসেম্বর দুপুরে শহরের ইকবালপুর এলাকার করিমন (৬৪) নামের এক নারী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ তুলে রোগীর স্বজনরা জরুরি বিভাগে হামলা চালায়। এতে কর্তব্যরত চিকিৎসক চিরঞ্জীব সরকারসহ চারজন ইন্টার্ন চিকিৎসক গুরুতর আহত হন। এর জের ধরে ওই দিন হাসপাতাল এলাকায় বহিরাগত লোকজন ও ইন্টার্ন চিকিৎসদের মধ্যে ধাওয়াধাওয়ির ঘটনা ঘটে। হামলার ঘটনায় হাসপাতালের সহকারী পরিচালক চিকিৎসক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমানের দায়ের করা মামলার আসামিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত শহিদুল ইসলাম (৪২) ও সাইদুর রহমান (৩৮) নামের দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে সদর থানা পুলিশ।