ভিক্ষুক নজিমুদ্দীন সারা বিশ্বে একটি মহৎ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন : প্রধানমন্ত্রী

ভিক্ষুক নজিমুদ্দীন

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

ভিক্ষুক নজিমুদ্দীন সারা বিশ্বে একটি মহৎ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ২৭ এপ্রিল সকালে করোনাভাইরাস বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে শেরপুর জেলাসহ আরও কয়েকটি জেলার সাথে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হন। এ সময় তিনি সবার উদ্দেশে ভিক্ষুক নজিমুদ্দীন প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। এ আলোচনার সময়কাল ছিল দুই মিনিট পাঁচ সেকেন্ড।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়টি সারা বিশ্বে একটি মহৎ দৃষ্টান্ত তিনি সৃষ্টি করেছেন। এতবড় মানবিকগুণ অনেক বিত্তশালীর মাঝেও দেখা যায় না। একজন নিঃস্ব মানুষ যার কাছে এই টাকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ওই টাকা দিয়ে সে দুটো জামা কিনতে পারতো, ঘরের খাবার কিনতে পারতো। এছাড়া করোনাভাইরাস নিয়ে যে অসুবিধা ওই টাকা দিয়ে সে নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারতো। আর এ অবস্থায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা পাওয়াও মুশকিল। কিন্তু সেসব চিন্তা না করে নজিমুদ্দীন তার শেষ সম্বলটুকু দান করে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এখনও সেই মানবিকতা বোধ আছে। সেটা পাই আমরা নিঃস্বদের কাছ থেকেই। দেখা যায় অনেক বিত্তশালীরা হা হুতাশ করেই বেড়ায় তাদের নাই নাই অভ্যাসটা যায় না। তাদের চাই চাই ভাবটাই সবসময় থেকে যায়।

২৭ এপ্রিল সকালে শেরপুরের ঝিনাইগাতীর গান্ধীগাঁও গ্রামে গেলে অশীতিপর ভিক্ষুক নজিমুদ্দিনের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমি তো খুশির উপরে খুশি, হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) যহন জিনিসটে আমারে দিছে, আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন হাসিনারে সুহে (সুখে) রাহে, হায়াত বাড়াইদেয়।

২১ এপ্রিল কর্মহীনদের খাদ্য সহায়তার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ত্রাণ তহবিলে ১০ হাজার টাকা দান করেন ওই ভিক্ষুক। গত দুই বছরে সঞ্চয়ের ওই টাকা দান করেন নজিমুদ্দিন। নিজের ভাঙা বসতঘর মেরামত করার জন্য ভিক্ষা করে ওই টাকা তিনি জমিয়েছিলেন। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে।

এ বিষয়ে ঝিনাইগাতী উপজেলার ইউএনও রুবেল মাহমুদকে ফোন দেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব-(১) সালাহ উদ্দিন। নির্দেশনা অনুযায়ী রাতেই ভিক্ষুক নজিমউদ্দীনের বাড়িতে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

২২ এপ্রিল দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষ রজণীগন্ধায় নজিমুদ্দিনকে দেওয়া হয় সংবর্ধনা। এ দিন তার হাতে নগদ ২০ হাজার টাকা ও প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রী তুলে দেন জেলা প্রশাসক।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এ বি এম এহসানুল মামুন জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় নজিমুদ্দীন পাচ্ছেন ১২ শতক জমি এবং পাকা বাড়ি। এছাড়া জীবিকা নির্বাহের জন্য জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে দেয়া হবে একটি মুদি দোকান। এখন আমরা সে সব কিছু দ্রুত সময়ের মধ্যে তার কাছে বুঝিয়ে দিবো।

এর আগে অন্য কোথাও দান করেছেন কিনা জানতে চাইলে নজিমুদ্দীন বলেন, অনেক দিন আগে যহন কামাই-টামাই করছি তহন জুম্মাঘর, মাদরায় ১০০, ২০০, ৫০০ টেহা দান করছি। কিন্তু যহন বয়স হইল, বুইড়ে হইলাম তহন তো আমার কামাই করবার উপায় নাই, খড়ি-টড়ি (লাকড়ি) কাইটে আর কোদালের আছাড়ি বানায়ইয়া বাজারত বিক্রি কইরা সংসার চালাইতাম। একদিন পাহাড়ের ড্রেনে পুইড়ে গেয়ে (পড়ে গিয়ে) পা ভাঙল, কাম-কাজ করবার পাই না। মানুষ কামলাও নেই না। পরের থেইক্যা ভিক্ষা কইরে খাওয়া শুরু করলাম। তাই আর দান করবের পাই নাই।

এবার কেন দান করতে ইচ্ছা হলো এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভিক্ষা করতে করতে খাইয়ে-খুইয়ে ১০ হাজার টেহা ডাইনে (আয়) হইল। টেহাডি ঘর-দরজা ঠিক করবার জন্যে তুইছিলাম (রাখা হয়ে ছিল)। কিন্তু এহন দেশে আইলো করোনা, শুরু হইল দশের অভাব। ভাবলাম বয়স হইয়া গেছে মইরাই যামুগা। এই ট্যাহাগুলান যদি মাইনসের কাজে লাগে, এই চিন্তার থ্যাইক্কা দশের জন্যে টেহাগুইলে ইউএনওরে দিমু। কিন্তু আমি তো ইউএনওরে চিনি না। তাই বকুল মেম্বার আর লতিফা মেম্বারনীরে কইলাম আমারে ইউএনও সাবের কাছে নিয়া যাও। পরে ইউএনওর হাতে দশের জন্যে টেহাগুইলে দিলাম।

ব্যক্তি জীবনে নজিমুদ্দীন তিনটি বিয়ে করেছেন। তার প্রথম স্ত্রীর নাম ময়না খাতুন। সে ঘরে মমেন আলী নামে তার এক ছেলে রয়েছে। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম হালেমা বেগম। ওই ঘরে নজেদা খাতুন নামে এক কন্যা সন্তান আছে তার। এ মেয়েটি মানসিক রোগী। ওই দুই স্ত্রীর সাথে অনেক আগেই তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আর বর্তমান স্ত্রীর নাম আবেদা খাতুন। আবেদা বিকলাঙ্গ ও মানসিক রোগী। এ ঘরে আসকর আলী, সুন্দরী, তানজিলা ও আব্দুল্লাহ নামে চারজন সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে ছেলে আসকর আলী বিয়ে করে আলাদা থাকে, আর মেয়ে সুন্দরীর বিয়ে হয়েছে বেশ কিছু দিন আগে।

ছেলে মেয়েরা আপনার খোঁজ খবর নেয় কিনা জানতে চাইলে নজিমুদ্দীন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রী পাওয়ার পর তারা (ছেলে মেয়েরা) দেখা করতে এসেছিল বলে জানান তিনি।

ভিক্ষুক নজিমুদ্দীনের জন্ম ১৯৪০ সালে। দুই ভাই আর দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।

সূত্র জানায়, ২৭ এপ্রিল সকালে ঝিনাইগাতী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভিক্ষুক নজিমুদ্দীনকে এক মাসের খাদ্য সামগ্রী উপহার দেওয়া হয়েছে। খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে ছিল চাল, ডাল, তেল ও আলুসহ অন্যান্য সামগ্রী।

জেলা প্রশাসক আনারকলি মাহবুব বলেন, নজিমুদ্দীন ভিক্ষুক হলেও হৃদয়ের দিক দিয়ে অনেক ধনশালী। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থাকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি আবারও প্রমাণ করলেন মানুষ মানুষের জন্য। প্রাণঘাতী করোনা পরিস্থিতিতে তার সেই অবদানে সম্পদশালীরাও আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নজিম উদ্দিনকে বয়স্কভাতা দেওয়া হবে। এবং তিনিসহ তার স্ত্রী আবেদা খাতুনের চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব নেয়া হয়েছে।