বঙ্গমাতা ছিল বঙ্গবন্ধুর শক্তি, সাহস ও প্রেরণার উৎস

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব
সৈয়দ নাজমুল হুদা

জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান, মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহিয়ান। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে যে মহীয়সী নারীর ত্যাগ ও সংগ্রাম জড়িয়ে আছে তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করার জন্য ছায়াসঙ্গী হিসেবে কাজ করেছেন বঙ্গমাতা।

বেগম মুজিব ছিলেন একজন আদর্শ নারী, স্বার্থক মাতা। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ উপদেষ্টা, পরামর্শদানকারী, একটি স্মরণীয় নাম, একটি ইতিহাস ও সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর শক্তি ও প্রেরণার উৎস। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন কোমলে কঠোরে মিশ্রিত একটি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন প্রতিভাবান নারী। অসীম সাহস, ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতার সাথে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কখনো কার্পণ্য করেননি বেগম মুজিব। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ফ্রেন্ড, ফিলোসোফার এবং গাইড। বঙ্গবন্ধু বলতেন আমার জীবনে দুটি অবলম্বন আছে একটি আমার আত্মবিশ্বাস, অপরটি আমার স্ত্রী।

বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে জেলে থাকা অবস্থায় একটি চিঠিতে লিখেছিলেন। সেই চিঠির কিছু অংশ বিশেষ ‘আপনি আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি। দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন, দেশের কাজই আপনার সব চাইতে বড় কাজ, আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান, আমার জন্য চিন্তা করবেন না।’ ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবিকে কেউ কেউ ছয় দফা না আট দফা তা নিয়ে বিভ্রান্ত ছিলেন। এক্ষেত্রে বঙ্গমাতা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গমাতা বললেন, ছয় দফা থেকে আমাদের এক পাও পিছু হটা যাবে না। যেকোনো মূল্যে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ছয় দফা বাস্তবায়িত করতে হবে। বঙ্গমাতা ছয় দফার সমর্থনে বোরকা পরে জনসংযোগ করতেন। যে ছয় দফা পরবর্তীতে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করতেন, মামলায় প্রতিটি বন্দি পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেয়া ও নিঃশর্ত মুক্তির সিদ্ধান্তে পাহাড়ের মত অটল থেকে সংগ্রাম করে সফলতা ছিনিয়ে এনেছেন এই মহীয়সী নারী। দেশপ্রেমের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, চেতনা, আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে শক্তি, সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর কারাগারে থাকাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংকট দেখা দিলে বঙ্গমাতা পর্দার অন্তরালে থেকে দৃঢ়, কৌশলী এবং বলিষ্ঠ ভূমিকার মাধ্যমে সংগঠনের জন্য কাজ করতেন। বঙ্গমাতা ভালবাসতেন দেশকে। দেশের মানুষের কল্যাণে, নিজেকে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে উৎসর্গ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। দেশপ্রেম থেকে সমাজ সংস্কারের জন্য ছিল তার অদম্য আগ্রহ। এজন্য তিনি একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। আর এই সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে নিরবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে কাজ করেছেন বঙ্গমাতা। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছেন বঙ্গমাতা।

সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মুহূর্তে বঙ্গমাতার কি ভূমিকা ছিল? বঙ্গমাতার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্যে মিলেছে সে সন্ধান- জনসভায় যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে আব্বা কাপড় পরে তৈরি হবেন। মা আব্বাকে নিয়ে ঘরে এলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আব্বাকে বললেন ১৫ মিনিট চুপচাপ শুয়ে থাকার জন্য। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে মাথা টিপে দিচ্ছিলাম। মা বেতের মোড়াটা টেনে আব্বার কাছে বসলেন। যেকোনো বড় সভায় বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার আগে আমার মা আব্বাকে কিছুক্ষণ একদম নিরিবিলি রাখতেন। মা আব্বাকে বললেন, সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার মনে যে কথা আসে তুমি তাই বলবে। অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে। তোমার কথার ওপর সামনের অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত। বঙ্গমাতার পরামর্শ, সাহস ও প্রেরণা থেকেই বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক সেই ভাষণ আজ ইউনোস্কো কর্তৃক স্বীকৃত লাভ করেছে। এনেছে স্বাধীনতা ছিনিয়ে। পূরণ করেছে ৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খাকে।

টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে বাঙালি জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য, ইতিহাসের পাতায় চলমান, তিনি আর কেউ নন তিনি হচ্ছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জাতির পিতার জীবনে যেমন বাংলাদেশে ও স্বাধীনতা শব্দটি মিশে আছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর জীবনে বঙ্গমাতা আলোকবর্তিতা ও অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় এই মহীয়সী নারীর অবদান জাতি কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করবে। নারীর অবদান, গুরুত্ব ও ক্ষমতায়নে নানা জাতির পথিকৃৎ হয়ে রবে তোমার কর্মযজ্ঞ। দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে প্রতিটি নারীকে। বাংলার প্রতিটি মানুষের মনের মনি কোঠায় স্মরণীয় হয়ে রবে তোমার কর্মময়। পরাধীনতার যন্ত্রনা ও গ্লানি এবং বেকারত্বের হতাশা ও অসন্তোষ থেকে মুক্তির সংগ্রামে অন্যতম পথপদর্শক ছিলেন বঙ্গমাতা। শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের সাথে বঙ্গবন্ধুকে কখনও আপস করতে দেননি এই মহীয়সী নারী।

এ দেশের জনগণের শতকরা আশি ভাগ কৃষক ও কৃষিনির্ভর ছিল। বঙ্গবন্ধু কৃষকের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। স্বার্থ বা অন্যায়ের সাথে আপসের ক্ষেত্রে বঙ্গমাতার একটি ঘটনা উল্লেখ করি। ১৯৭১ সালের ২৩ বা ২৪ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগের সাথে পিপিপি’র সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করার প্রস্তাব আসে বঙ্গবন্ধুর কাছে। এই প্রস্তাব আসার সাথে সাথে বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেন- ‘দেখো আমি তোমার রাজনীতি করি না, তুমি যদি ভুট্টোর সাথে কোয়ালিশন করো তবে লোক এই বাড়িতে পাথর মারবে। আমি এ বাড়ি থাকবো না, টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে চলে যাব।’

এমন দৃঢ়চেতা মনোভাব ও সাহসী ভূমিকার কারণে বঙ্গবন্ধু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যদি সে সময়ে কোয়ালিশন করতেন তবে আমরা কি স্বাধীনতা ও স্বাধীন দেশ পেতাম। এটা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গমাতার দৃঢ়চেতা মনোভাব ও ব্যতিক্রমী ভূমিকার কারণে। বাংলা ও বাঙালি জাতির মুক্তির আলোর দিশারী ছিলেন বঙ্গমাতা। মুক্তিকামী মানুষের কল্যাণে চিন্তায় নিজের পরিবারের কথা না ভেবে বঙ্গবন্ধুকে যুগিয়েছেন সাহস ও প্রেরণা।

আজ স্বাধীন বাংলায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ে। আমারা মুক্ত কণ্ঠে আমার সোনার বাংলা গান গাই। আমরা পাকিস্তানসহ সকল অপশক্তির নাগ পাশ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছি। এই স্বপ্ন যে দেখেছিল তিনি আমাদের মাঝে নেই। নেই তার অনেক পরম আপন জনেরা। বঙ্গমাতাসহ সকল শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

লেখক : সৈয়দ নাজমুল হুদা, প্রভাষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।